করোনা মোকাবেলায় সরকারের সহায়তা: শিল্প উদ্যোক্তারা চান এক বছরের মাস্টার প্ল্যান

নন্দিত ডেস্ক:চলমান করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবসায়ী সংগঠনের সিনিয়র নেতারাসহ বেশির ভাগ শিল্প উদ্যোক্তা সরকারের কাছে দ্রুত মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের দাবি করেছেন। তারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে গত ক’দিনে যে ক্ষতি হয়েছে তা সামাল দিতে কয়েক বছর লেগে যাবে। আর যদি এটি কোনো কারণে দীর্ঘায়িত হয় তাহলে তো বিপদের শেষ নেই। তাদের মতে, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের উচিত হবে, এখনই জরুরি ভিত্তিতে অন্তত এক বছরের একটি গ্রহণযোগ্য মাস্টার প্ল্যান হাতে নেয়া। যেখানে প্রধান সুবিধা হিসেবে শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের কিস্তি ও সুদ প্রদানের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ বছরের গ্রেস পিরিয়ড দিতে হবে। এছাড়া শিল্প টিকিয়ে রাখতে ন্যূনতম সার্ভিস চার্জ নিয়ে প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদান করা। এজন্য প্রয়োজনে বড় প্যাকেজের তহবিল গঠন করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকার এই বিপদের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ব্যবহার করতে পারে। অপরদিকে সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল বরাদ্দে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা নিয়ে ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। তারা বলেন, এটি তো কোনো অনুদান নয়, ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ। যা শিল্প মালিকদের পরিশোধ করতে হবে। তাহলে শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিচয়পত্রসহ তালিকা ব্যাংকে জমা দেয়ার নানান শর্ত জুড়ে দেয়ার হেতু কী। এটা তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিল্প উদ্যোক্তা শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, নীতিমালার পদে পদে অসঙ্গতিতে ভরা। এটি পড়ে যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে ২০ এপ্রিলের মধ্যে আবেদন জমা দেয়ার পর শুরু হবে আমলাতান্ত্রিক নানান হয়রানি। শেষ পর্যন্ত এটি ঘুষ-দুর্নীতির ফাঁদেও আটকা পড়তে পারে। তারা বলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ মালিক নিয়ম মেনে এতদিন তো শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিয়ে আসছেন। যেমন মার্চের বেতন দেয়া হবে। তাহলে এপ্রিল থেকে বেতন দেয়া নিয়ে এত শর্তের বেড়াজাল চাপিয়ে দেয়া হল কেন। বরং হওয়া উচিত ছিল, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মোট শ্রমিক-কর্মচারীর বিবরণসহ সমুদয় বেতনের পরিমাণ উল্লেখ করে ঋণ আবেদন করবে। এরপর ঋণ রিলিজ করতে হবে। তা না করে যেভাবে নীতিমালা করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে এটি একেবারে অফেরতযোগ্য অনুদান। সেটি ভাবা হলে ব্যাংকের মাধ্যমে একেবারে শ্রমিক-কর্মচারীদের হাতে বেতন দেয়া হোক। মালিকরা ওই টাকার কোনো দায়-দায়িত্ব নিতে পারবে না। তাদের মতে, এভাবে যারা জটিল নীতিমালা জারি করেছেন তারা প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীর একটি ভালো উদ্যোগকে সমালোচনার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একই সঙ্গে এই সুবিধা শুধু রফতানিমুখী শিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন। একজন শিল্পপতি যুগান্তরকে বলেন, করোনাভাইরাস যেভাবে বিশ্বজুড়ে আঘাত হেনেছে তাতে আগামীতে বিশ্বের পুরো অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এক রকম ধসে পড়বে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা কী হতে পারে সেটি বুঝতে কাউকে অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগবে না। এ কারণে বিশ্বের বড় বড় দেশ একদিকে যেমন করোনা মোকাবেলা করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে, অপরদিকে করোনার আফটার ইফেক্ট সামাল দিতে জরুরি, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের পথনকশা এখনই প্রস্তুত করছে। প্রথমত, তারা ব্যবসা-বাণিজ্য সেক্টরে অকাতরে অর্থ বরাদ্দ রাখা ছাড়াও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিস্তর পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও ইতোমধ্যে মেগা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। তাই আমাদের এখানে সেই পরিসরে সম্ভব না হলেও সামর্থ্য অনুযায়ী আগেভাগে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় প্যাকেজ ঘোষণা দিয়ে ব্যবসায়ী সমাজকে শান্ত রাখতে হবে। তা না হলে অনেকে এ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে মিল-কলকারখানা বন্ধ করে বসে থাকতে বাধ্য হবে। সেক্ষেত্রে বেকার সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। তারা বলেন, এজন্য সরকার একটি প্রস্তাবকে ভেবে দেখতে পারে। সেটি হল, এ মুহূর্তে এক বছরের জন্য একটি কর্মসূটি ঘোষণা করা। যেখানে শিল্প উদ্যোক্তাসহ সব শ্রেণির ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের কিস্তি ও সুদের ওপর এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড বা ছাড় দেয়া। অর্থাৎ আগামী এক বছর ব্যবসায়ীদের কোনো ঋণের কিস্তি যেমন পরিশোধ করতে হবে না, তেমনি ওই ঋণের ওপর কোনো সুদও আরোপ করা হবে না। পাশাপাশি বড় এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে একেবারে স্বল্প সুদে বিশেষ ঋণ প্রদানের সুবিধা দিতে হবে। স্বভাবত প্রশ্ন উঠবে- তাহলে ব্যাংক চলবে কিভাবে। উত্তরটা হল- ব্যাংকের কর্পোরেট ট্যাক্স হ্রাস করা যেতে পারে। এছাড়া পরিচালনা ব্যয় সচল রাখতে সরকার ব্যাংককে বিশেষ তহবিল দিতে পারে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সেক্টর এক বছরের জন্য একটা ব্রিদিং টাইম পাবে। এখানে সরকার চাইলে ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের এ সুবিধার বাইরে রাখতে পারে। এটি বেশির ভাগ ব্যবসায়ী সমর্থন করবে। ফলে জাল-জালিয়াতি করে ঋণ নেয়া তো দূরের কথা, যাদের কোনোদিন ঋণখেলাপির তকমা স্পর্শ করেনি তারা এই বিশেষ প্যাকেজের সুবিধা নিয়ে দেশকে আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে পারবে। এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরকারের ৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে সব মহলে একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের স্বার্থে এই টাকা সরকার ব্যবসায়ীদের ঋণ হিসেবে দিয়েছে। আর ঋণের আবশ্যিক শর্ত তো মালিকদের মানতে হবে। তাহলে শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই এই টাকা কেন দিতে হবে বা টাকা ছাড়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের শর্ত কেন জুড়ে দেয়া হল তা বোধগম্য নয়। তিনি আরও বলেন, শিল্পের স্বার্থে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ এক বছরের জন্য স্থগিত করে পরবর্তী ৫ বছরে তা সমন্বয়ের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বেতনের শিটের পাশাপাশি শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। এতে উদ্যোক্তাদের ঝামেলা বাড়বে। কারণ একটি গার্মেন্ট বা টেক্সটাইলে হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। তাছাড়া সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৫ হাজার টাকার কম বেতনভোগী শ্রমিকদের বেতন নগদে দেয়া হয়। আবার অনেক শ্রমিকের জাতীয় সনদপত্রও নেই। এসব ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবে। তিনি আরও বলেন, দেশের অন্য সব শিল্পকেও এই প্রণোদনার আওতায় আনা উচিত। কারণ শ্রম তো শ্রমই। সেটা রফতানিমুখী খাতে হোক বা স্থানীয় শিল্পে। শ্রমের মধ্যে পার্থক্য-বিভেদ নেই। তাছাড়া গার্মেন্ট শিল্প দেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে সুতা ও কাপড়ের মিলগুলোর অনেক অবদান আছে। অনেক সুতা ও কাপড়ের মিল স্থানীয় পর্যায়ে কাপড়ের জোগান দিচ্ছে। ফলে বিদেশ থেকে কাপড় আমদানি কমেছে। ব্যাংক ঋণের বিষয় খোকন বলেন, এই সংকটময় মুহূর্তে এক বছরের জন্য ঋণের সুদ মওকুফ ও কিস্তি পরিশোধ থেকে ব্যবসায়ীদের রেহাই দেয়া উচিত। পরে হালকা ও ভারি শিল্প বিবেচনায় ঋণের মেয়াদ ২-৩ বছরে বাড়িয়ে আদায় করলে হয়তো সংকট মোকাবেলা করে দেশীয় শিল্প টিকে থাকতে পারবে। তিনি আরও বলেন, অর্থের সংস্থানে প্রয়োজনে সরকার রিজার্ভ ব্যবহার করতে পারে। রফতানিকারকদের ইডিএফ বা অফশোর ফান্ডে ডলারে ঋণ দেয়া হলে পরে ব্যবসায়ীরা তা ডলারে পরিশোধ করবে। তাহলে ডলার নষ্ট হবে না। সর্বোপরি সংকট মোকাবেলায় সরকারকে এখনই একটি মাস্টার প্ল্যান করতে হবে। বিকেএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারই প্রমাণ করে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কিভাবে ব্যাহত হয়। অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মতামত না নিয়ে একতরফাভাবে বাস্তবতাবিবর্জিত শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। কেননা যেখানে দেশের শতভাগ মানুষই জাতীয় পরিচয়পত্র পায়নি, সেখানে শ্রমিকদের সবার পরিচয়পত্র রয়েছে সেটা ভাবা বোকামি। তাছাড়া ৯০ ভাগ কারখানা শ্রমিকদের হ্যান্ডক্যাশে বেতন দেয়। যেসব বড় কারখানা বিকাশ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেতন দেয়, সেখানেও জটিলতা আছে। যেসব শ্রমিকের পরিচয়পত্র নেই তাদের হাতেই বেতন দেয়। তিনি বলেন, সরকার ৬ মাসের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শিথিল করেছে। কিন্তু এখানেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সুদের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এসব কিস্তির ওভারডিউ সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে পরে ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে বিশাল বোঝা হিসেবে চেপে বসবে, যা বহন করা সম্ভব নয়। ওই সার্কুলারে সুদের কথা উল্লেখ না করায় ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্তত আগামী ১ বছরের জন্য ঋণের কিস্তি এবং সুদ মওকুফ করে সরকারকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাত বিগত দিনে বহু ব্যবসা করেছে। তাই এই মহামারীতে ব্যাংকিং খাতকে দেশের জন্য দেয়ার সময় এসেছে। শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কম্প্রিহেনসিভ প্যাকেজ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সরকার শ্রমিকদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করেছে, যা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যদি শিল্পই মরে যায় তাহলে ভবিষ্যতে শ্রমিক বাঁচবে কিভাবে? ইতোমধ্যে যেসব অর্ডার বাতিল হয়েছে তার বিপরীতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির দায় সৃষ্টি হয়েছে। এই টাকা কিভাবে পরিশোধ হবে, করোনা-পরবর্তী প্রভাব বিবেচনা করে বেইল আউট বা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে সরকারকে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিকে ঋণ ও অনুদান দুটোই দিয়েছে।