রেমিট্যান্সের জাদুতে ভাটা

সবাই বলে থাকেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত দু’টি বড় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিকশিত হচ্ছে যার একটি হচ্ছে- প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং অন্যটি তৈরি পোশাক রপ্তানি। বাংলাদেশের জিডিপিতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে এ দু’টি খাতের অবদানই সবচেয়ে বেশি। করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির এ দু’টি ভিত্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনাকালে বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে ২০২০ সালের ১৫ই মে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স খাতেই সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতির এ দু’টি বড় ভিত্তিই এখন দেশটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে রেমিটেন্স এর সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনার কারণে এখন বড় ধরনের মন্দা চলছে। শ্রমিক ছাঁটাই ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতেও মন্দার কারণে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা রয়েছে। এসব কারণে রেমিটেন্সে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা নিয়ে সতর্ক করছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু অনেকেই তাতে কর্ণপাত না করে আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলেন কারণ প্রতিমাসেই পত্রিকাগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছিল- করোনার মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠালেন প্রবাসীরা, গত বছরের (এই মাসের) তুলনায় এ বছরের (এই মাসে) রেমিটেন্সের পরিমাণ বেশি ইত্যাদি। অর্থনীতিবিদরা তখন সতর্ক করে বলছিলেন নানা কারণে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে। অনেক প্রবাসী বিদেশে চাকরি হারিয়েছেন কিংবা অনেকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে তাই তারা সব সঞ্চয় দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, রেমিটেন্সে ২ শতাংশ প্রণোদনা রয়েছে যে কারণে বৈধ পথে রেমিটেন্স বাড়ছে, তাছাড়া করোনার কারণে বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে আসা লোকের সংখ্যা কমে গেছে যে কারণে এতদিন যারা হাতে হাতে টাকা পাঠাতেন তারাও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। অবশেষে চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের তুলনায় কমে যায়। জুলাই মাসে প্রবাসীরা ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠান যা আগের চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৯ শতাংশ কম। সদ্য বিদায়ী আগস্ট মাসেও কমেছে রেমিটেন্স প্রবাহ। এ মাসে ১৮১ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ কোটি ডলার কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাসে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ৩৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। অথচ আগের বছরের একই সময়ে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ৪৫৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত ৮ই আগস্ট ‘জাতীয় বাজেট-২০২১-২২ বাস্তবায়ন: পিছিয়ে পড়া মানুষেরা কীভাবে সুফল পাবে?’- শীর্ষক এক সংলাপে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য সতর্ক করে বলেছিলেন, “বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত হবেন রেমিটেন্সের যে জাদু সেটা সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। কারণ, মানুষ বিদেশে গিয়েছে কম, এসেছে বেশি। সরকারি প্রণোদনার কারণে হুন্ডি থেকে মানুষ ব্যাংকিং খাতে টাকা পাঠিয়েছে। এ অবস্থায় জাদু শেষ হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাই বোঝার বিষয় রয়ে গেছে। রপ্তানি আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কর আদায়সহ সব সূচক যদি বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে দেখবেন প্রাথমিক সংকেত ভালো না।” জুলাই মাসে রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স প্রবাহ দুই খাতেই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ওদিকে জুলাই মাসেই বাংলাদেশের জন্য আরেকটি নেতিবাচক খবর আসে। বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে টপকে একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে চলে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম। আর দীর্ঘদিন দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ নেমে যায় তৃতীয় স্থানে। জুলাইয়ের ৩০ তারিখ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যেখানে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। আগের বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। আর ভিয়েতনামের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার। রপ্তানির পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানিতে অবদানও কমেছে বাংলাদেশের। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বিশ্বে যত পোশাক রপ্তানি হয়েছিল তার মধ্যে ৬.৮ শতাংশ ছিল বাংলাদেশি। অন্যদিকে ২০১৯ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের অবদান ছিল ৬.২ শতাংশ। যাই হোক ৬.৮ শতাংশ থেকে কমে বাংলাদেশের অবদান ২০২০ সালে হয়েছে ৬.৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনামের বেড়ে হয়েছে ৬.৪ শতাংশ। ২০০০ সালে বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ২.৬ শতাংশ অবদান ছিল বাংলাদেশের, যেখানে ভিয়েতনামের ছিল ০.৯ শতাংশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের ছিল ৪.২ শতাংশ। আর ভিয়েতনামের ছিল ২.৯ শতাংশ। এর মানে ১০ বছরের ব্যবধানে অনেকটাই পিছিয়ে থাকা ভিয়েতনামই টপকে গেছে বাংলাদেশকে!