এবার শাস্তির মুখোমুখি সেই কারা ডিআইজি

ঘুসের প্রায় কোটি টাকা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন কারা ডিআইজি বজলুর রশীদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত তদন্তেও এটি প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি এসএ পরিবহণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্ত্রী রাজ্জাকুন নাহারের নামে থাকা সিমের মাধ্যমে এই বিপুল অঙ্কের টাকা পাঠানোর বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে। মামলাসংশ্লিষ্ট অডিও-ভিডিও ক্লিপ এবং সাক্ষীদের জবানবন্দিতে সবকিছু স্পষ্ট হয়েছে। সাময়িক বরখাস্তকৃত এই ডিআইজি কীভাবে, কার মাধ্যমে কত দফায় এই টাকা পাঠিয়েছেন তার আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদনে। গত ২৯ জুন তদন্ত বোর্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে ১৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি জমা দেয়। সূত্র জানায়, অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে এখন বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত বোর্ডের কাছে মৌলিক অভিযোগগুলো প্রমাণিত হওয়ায় তার সামনে গুরুদণ্ডের মতো শাস্তিই অপেক্ষা করছে। এছাড়া এর ফলে এ সংক্রান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলাটি আরও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীকে প্রধান করে গঠিত কমিটির প্রাথমিক তদন্তেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এদিকে এ মামলায় সবচেয়ে বড় সাক্ষী ছিলেন এসএ পরিবহণের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আসাদুজ্জামান। তিনি তদন্ত বোর্ডের সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন, টাকা পাঠানো সংক্রান্ত ৩০টি মানি রিসিটের মূল কপি ইতোমধ্যে দুদক জব্দ করেছে। তাদের কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর বিষয়টি সত্য। এর সপক্ষে অফিসিয়াল ডকুমেন্ট রয়েছে। প্রসঙ্গত, ‘বেপরোয়া ডিআইজি প্রিজন্সের ঘুষ কাণ্ড, স্ত্রী কুরিয়ার সার্ভিসে নেন কোটি কোটি টাকা’ শিরোনামে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর যুগান্তরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। চাঞ্চল্যকর এই রিপোর্টের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠনসহ দুদকও অনুসন্ধান শুরু করে। তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদনের এক স্থানে বলা হয়, বজলুর রশীদের স্ত্রী রাজ্জাকুন নাহারের নামে ০১৮৫৬৫৫৭৩৫৮ নং মুঠোফোনের সিমটি নিবন্ধিত। এই সিম নম্বর ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে এসএ পরিবহণের মাধ্যমে তৌহিদ হোসেন মিঠু ২৪টি রসিদে ৯০ লাখ ৩৫০ টাকা এবং বাকি ৬টি রসিদে বিথি ও দুলাল পাঠায় ৮ লাখ টাকা। কিন্তু টাকা লেনদেনসংশ্লিষ্ট সিমটি হারিয়ে গেছে বলে দাবি করেন রাজ্জাকুন নাহার। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো জিডি করেননি। যুগান্তর প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে অর্থ দাবির অভিযোগটিও প্রমাণ করতে পারেননি ডিআইজি বজলুর রশীদ। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জেল সুপার নেছার আলমের বিপদ ভেবে নয়, বরং অভিযুক্ত বজলুর রশীদ প্রতিবেদকের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে রাত ১০টার দিকে হোটেল সোনারগাঁওয়ে গিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত অডিও-ভিডিও ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে কমিটি নিশ্চিত হয়েছে যে, বজলুর রশীদ নিজেই প্রতিবেদককে ঘুস প্রদানের চেষ্টা করেছেন। নিজের অপরাধ মেনে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। অভিযুক্ত ডিআইজির স্ত্রী রাজ্জাকুন নাহার লিখিত বক্তব্যে বলেন, তৌহিদ হোসেন মিঠুকে তিনি চেনেন। তার বাবা আবুল খায়ের ডিপার্টমেন্টে (কারাগার) জমাদার ছিলেন। মিঠুর কাছ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে টাকা নেননি। তবে ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কুমিল্লাতে যখন ছিলেন তখন কখনো ১ লাখ, কখনো দেড় লাখ, কখনো দুই লাখ করে টাকা নিয়েছেন। আনুমানিক ৯০ লাখ টাকা নিয়েছেন হাতে হাতে। এই টাকা লেনদেনের বিষয়ে ২০১৩ সালে তাদের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র হয়। যেখানে বলা আছে, ২০২৩ সালের মধ্যে এই টাকা তিনি মিঠুকে ফেরত দেবেন। তদন্ত বোর্ডের সামনে দুলাল বলেছেন, এসএ পরিবহণের মাধ্যমে তিন দফায় তিনি ৭১ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। অপর আত্মীয় বিথি আক্তার বলেন, ‘বজলুর রশীদ সম্পর্কে তার নানা হয় এবং উনার স্ত্রী রাজ্জাকুন নাহার নানি। নানিকে তিনি এসএ পরিবহণের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঘুসের টাকা লেনদেনের অন্যতম হোতা ছিলেন তৌহিদ হোসেন মিঠু। তিনি তদন্ত বোর্ডের সামনে উপস্থিত হননি। ডাকযোগে লিখিত বক্তব্য পাঠান। সেখানে তিনি মূল বক্তব্য হিসাবে উল্লেখ করেন ডিআইজি বজলুর রশীদের স্ত্রী রাজ্জাকুন নাহার ২০০৮ সালের ৭ জুলাই তার বড় বোন নাসরিন আক্তারের স্বামী নজরুল কবীরের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে ৯০ লাখ টাকা নেন। এর বিপরীতে লাভসহ ১০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন কিস্তিতে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করবেন। এ বিষয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্ট্যাম্পে চুক্তিনামাও করা হয়। যা ২০১৩ সালে নোটারি পাবলিকও করা হয়েছে। কিন্তু তার বড় বোনের স্বামী ও সন্তান নেই। এ কারণে রাজ্জাকুন নাহারের সঙ্গে তিনিই চুক্তিনামা করেছেন। ডিআইজি বজলুর রশীদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধানে নামে। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর জবানবন্দি নিতে তাকে দুদকে তলব করা হয়। সেখানে তাকে প্রায় ৩ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনার অর্থের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফ্ল্যাটটি তিনি ৩ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনেন। কিন্তু এই বিপুল অঙ্কের টাকার কোনো বৈধ উৎস তিনি দেখাতে পারেননি। এর পর ওইদিনই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ইতোমধ্যে দুদকের এই মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। চলছে বিচার কাজ। এক বছর ৯ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ২৯ অক্টোবর তিনি জামিন পান।