হৃদরোগের চিকিৎসায় কৃত্রিম ‘হার্ট অ্যাটাক’

সিলেটের বিয়ানিবাজার হেলথ কমপ্লেক্সের ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট নাজমুল হক মোল্লা। দেড় দশকেরও বেশি সময় হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছেন। প্রতি সাত থেকে ১০ দিনে একবার অজ্ঞান হয়ে যেতেন। শারীরিক অসুস্থতায় অফিসেও অনিয়মিত হয়ে পড়েন। বেতনও বন্ধ হয়ে যায়। সাত বছর চাকরি থাকা সত্ত্বেও কর্মস্থল থেকে অবসরোত্তর ছুটির (পিআরএল) আবেদনের জন্য তার ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। একপর্যায়ে জানতে পারেন তিনি হাইপারট্রপিক অবসট্রাকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (এইচওসিএম) নামে হৃৎপিণ্ডের একটি বংশগত রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেও অর্থাভাবে থেমে যেতে হয় তাকে। পরে তিনি জানতে পারেন সরকারিভাবেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) এই রোগের চিকিৎসা হয়। ১১তম রোগী হিসাবে তিনি সেখানে ভর্তি হন। বুক না কেটে স্বল্প খরচে কৃত্রিমভাবে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে এখন তার চিকিৎসার প্রস্তুতি চলছে। মঙ্গলবার এনআইসিভিডি’তে যুগান্তরের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরেন এইচওসিএম রোগে আক্রানসূত্র জানায়, সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের নেতৃত্বে এনআইসিভিডি’তে চলছে এইচওসিএম রোগের চিকিৎসা। অ্যালকোহল সেপ্টাল অ্যাব্লেশন পদ্ধতিতে সরকারিভাবে তিনিই প্রথম এ রোগের চিকিৎসা করছেন। মাত্র ৩০-৫০ হাজার টাকা খরচে ইতোমধ্যেই ১০ জন রোগী বিশ্বমানের এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা পেয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। অর্থাভাবে বিদেশে গিয়ে যারা এই রোগের চিকিৎসা করাতে পারেননি, তাদের অনেকেই এখন সরকারিভাবে ডা. প্রদীপের নেতৃত্বাধীন টিমের অধীনে চিকিৎসার অপেক্ষায় আছেন।

এইচওসিএম রোগটির বিষয়ে চিকিৎসকরা জানান, এটি হৃদ্যন্ত্রের একটি বংশগত ও জন্মগত রোগ। এটি হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির অসুখ। হার্টের চারটি চেম্বার রয়েছে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চেম্বার হলো বাম নিলয়। এই রোগে এই বাম নিলয়ের মাংসপেশি মোটা হয়ে যায়। মাংসপেশি মোটা হওয়ার কারণে হৃৎপিণ্ডের চাপ বেড়ে যায়। মূলত দুই নিলয়ের মাঝে অবস্থিত পার্টিশনে (বিভাজন) এই মোটা মাংসপেশি শরীরে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং মারাত্মক অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন তৈরি করে। এতে অনেক রোগী অজ্ঞান হয়ে যান। এই রোগীরা হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে যান, শ্বাসকষ্ট হয়, বুকে ব্যথা বা বুক ধড়ফড় শুরু হয়। কিছু কিছু রোগী হাঁটতে গেলে অথবা দৌড়াতে গেলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।

ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, এইচওসিএম রোগীর দুই ধরনের চিকিৎসা আছে। একটি বুক কেটে, আরেকটি বুক না কেটে ইন্টারভেনশনাল পদ্ধতিতে। বুক কাটা বা ওপেন হার্ট পদ্ধতিতে বুকের হাড় কাটতে হয়। এরপর হৃৎপিণ্ড থেকে মোটা হওয়া অতিরিক্ত মাংসপেশি কেটে নেওয়া হয়। বুক কেটে এই ধরনের চিকিৎসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে এই রোগের চিকিৎসা খুবই অপ্রতুল। বুক না কেটে ইন্টারভেনশনাল পদ্ধতিতে (অ্যালকোহল সেপ্টাল অ্যাব্লেশন পদ্ধতি) এই রোগের চিকিৎসা করা যায়। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ক্যাথেটার সিস্টেমের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডে শতভাগ অ্যালকোহল দিয়ে ওই মোটা মাংসপেশিতে নিয়ন্ত্রিত হার্ট অ্যাটাক ঘটানো হয়। হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে ওই মোটা মাংসপেশিকে পাতলা করা হয়। মাংসপেশি পাতলা হয়ে গেলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয় এবং রোগীর সমস্যা কমে যায়।

এনআইসিভিডির এই সহযোগী অধ্যাপক আরও জানান, এইচওসিএম রোগটি সাধারণত প্রতি ৫০০ জনে একজনের হয়ে থাকে। তাই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী এই ধরনের রোগে ভুগছেন। কেবল ঢাকায়ই এ রোগের আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজার জনের বেশি। এটি মূলত একটি বংশগত রোগ। এই রেগে যিনি আক্রান্ত হন, তার ছেলে-মেয়ে ভাই-বোনরাও এতে আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগীদের শনাক্তকরণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। রোগী ঠিকমতো জানেনও না কোথায় চিকিৎসা নিতে হবে। এভাবে দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে অনেক রোগী মারাও যান। অথচ এই ধরনের রোগ নির্ণয়ের জন্য ইসিজি এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফিই যথেষ্ট।

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে কথা হয় ডা. প্রদীপের অধীনে এইচওসিএম রোগের চিকিৎসা নেওয়া পঞ্চাশোর্ধ্ব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই কঠিন কোনো কাজ করতে পারতেন না। দীর্ঘক্ষণ হাঁটলেই ক্লান্তিবোধ করতেন, হাঁপিয়ে উঠতেন। ২০১৪ সাল থেকে এই সমস্যা বাড়তে থাকে। গত বছর থেকে এই সমস্যা প্রকট হয়। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারছিলেন না। অনেক বেশি গরম লাগত। অনর্গল কথা বলতেও সমস্যা হচ্ছিল। এরপর দেশের বড় বড় হাসপাতালে যাই। কোথাও কার্যকর সমাধান না পেয়ে ভারত যাওয়ার পরিকল্পনা করি। জীবনে বেঁচে থাকার আশাও কমে যেতে থাকে। পরে দেশের একটি স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মাধ্যমে ডা. প্রদীপের সন্ধান পাই। ২৫ আগস্ট হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। ৩০ আগস্ট আমাকে ওটিতে নেওয়া হয়। ৪০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা হয়ে যায়। ৫ সেপ্টেম্বর আমাকে রিলিজ দেওয়া হয়। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।

এর আগে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বুক না কেটে ট্রান্সক্যাথেটার এওর্টিক ভাল্ব রিপ্লেসমেন্ট (টিএভিআর) পদ্ধতিতে ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেছেন। দ্রুত সময়ে বাংলাদেশে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিক চালুর জন্য কাজ করছেন তিনি। যার মাধ্যমে একজন কার্ডিওলজিস্ট অপারেশন থিয়েটারে না থেকে দূর নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে হার্টের রিং পরানো যাবে।