করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন সুনামগঞ্জের তিন চিকিৎসক

করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর দিক থেকে প্রথম সারির যোদ্ধা হয়ে মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। জীবনকে বাজি রেখে তারা লড়ে যাচ্ছেন অদৃশ্য এক শক্তির বিরুদ্ধে। এখনও করোনার কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়ায় রোগীকে সরাসরি সেবা দিতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণও গেছে অনেকের। অন্য চিকিৎসকদের মতো করোনার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের তিন চিকিৎসক। তারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নির্ভয়ে। তাদের মধ্যে দুজন চিকিৎসক দম্পতি ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। এসব চিকিৎসকদের একটাই কথা- চিকিৎসক হওয়ার শপথ যখন নিয়েছি তখন মানুষের সেবা দিয়েই যাবো সুনামগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ওসমান হায়দার মজুমদার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সুমাইয়া আরেফিন শান্তা দম্পতি পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে আক্রান্ত হয়েও থেমে যাননি তারা। তারা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। আশা করা হচ্ছে, দুই-একদিনের মধ্যে পেয়ে যাবেন ছাড়পত্র। জানা যায়, ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ ওসমান হায়দার মজুমদার ২০১০ সালে ও তার স্ত্রী ডাক্তার সুমাইয়া আরেফিন শান্তা ২০১৬ সালে এমবিএস পাস করে মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। তাদের দায়িত্বে কোনো সময় ছিল না অবহেলার ছাপ। জরুরি প্রয়োজনে তাদের সবসময় পাশে পেয়েছে মানুষজন। করোনাভাইরাসের শুরু থেকে তাদের ওপর ছিল চাপ। আবুল বাশার সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কাজ করেছেন দিনের পর দিন। সেই কাজ করতে করতে তিনিও আক্রান্ত হয়ে যান করোনাভাইরাসে। তার মতো সুমাইয়া আরেফিনও আক্রান্ত হয়েছেন রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে। করোনায় আক্রান্ত হয়েও নিজেদের বাবা-মা বা পরিবারের কাউকে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি এ দম্পতি। বাবা-মা চিন্তায় পড়ে যাবেন বলে তারা বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। তবে তারা বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছেন বিশ্বম্ভরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারে। ছাড়পত্র পাওয়ার পর ঠিক আগের মতো নির্ভয়ে মানুষের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন এই চিকিৎসক দম্পতি। চিকিৎসক আবুল বাশার ও সুমাইয়া আরেফিন শান্তা বলেন, আমরা বর্তমানে আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। করোনা পজিটিভ হওয়ার পর থেকে আমরা নিজেদের কোয়ার্টারে থেকেছি। আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ঠিক সেভাবে চলেছি। খাওয়া-দাওয়া, ওষুধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা-সবকিছুই আমরা নিয়ম মেনে করেছি। আমরা করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর ভয় পাইনি। শুধুমাত্র নিজেদের বাবা-মা ও পরিবারের কাছে বিষয়টি গোপন রেখেছি। তারা বলেন, আমরা সুস্থ হয়ে গেলে আবার কাজে ফিরে যাব। এখন চিকিৎসকদের মানুষের পাশে থাকা খুব দরকার। আমরা যদি এখন পিছিয়ে যাই তাহলে আমরা আমাদের শপথ পূরণ করতে পারব না। আমরা যেহেতু ডাক্তার তাই আমাদের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে যাব। ডা. সুমাইয়া আরেফিনের বাবা রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামছুজ্জামান বলেন, আমার মেয়ে ও মেয়ের জামাই দুজনই ডাক্তার। এটি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা পোষণ করেছে ডাক্তার হবে, সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে আমার মেয়ে ও জামাই যে সাহসিকতা সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই। তারা ডাক্তার, তাদের কাজ মানুষের সেবা দেয়া। আমরা শুধু বলতে পারি, তোমরা সাবধানে থেকো। আর আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করতে পারি আমার সন্তানদের তুমি দেখে রেখো। তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে ও মেয়ের জামাই তাদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি আমাদের জানায়নি। তারা যখন আমাদের বিষয়টি জানিয়েছে তখন আমি এবং ওর মা অনেক কান্নকাটি করেছি। কিন্তু আমার মেয়ে ও মেয়ের জামাই আমাদের বুঝিয়েছে, আমরা সুস্থ আছি। আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়মানুযায়ী সবকিছু করছি। আমরা এখন সুস্থ এবং আমাদের ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। তখন আমরা একটু স্বস্তি পেয়েছি। কিন্তু যেহেতু আমাদেরই সন্তান তাই আমরা তাদের নিরাপদ থাকতে বলেছি। অন্যদিকে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ (রুমী)। সীমিত লোকবল নিয়ে প্রতিনিয়তই ছুটে বেড়াচ্ছেন উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে। দুইবার নিজের নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নেগেটিভও হন। বিদেশফেরত, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে ফেরত লোকদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে ছুটে গেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই সব ধরনের রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন তিনি। সীমিত সামর্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও ফেরত যাননি কোনো রোগী। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, স্বাস্থ্যকর্মী ও অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ চারজন করোনা পজিটিভ হলে গত ২৮ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণা করা হয় পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কম্পাউন্ড। এরপর আরও একজন নার্সসহ দুজনের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। তারপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশনে থাকা কর্মীদের নিরলস সেবা দিয়ে গেছেন ডা. রুমী। নমুনা সংগ্রহের জন্য মোটরসাইকেলে করে উপজেলার প্রতি প্রান্তেই ছুটে বেড়াচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন যেন নিশ্চিত করা যায় স্বাস্থ্যসেবা। তার সঙ্গে যোগ দেন তার স্ত্রী রাহাত জাহান চৌধুরী। হাসপাতাল কোয়ার্টারে আইসোলেশনে থাকা রোগীদের খাবার নিশ্চিত করতে রান্নার কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। প্রতিদিন রান্নার কাজ শেষে সবার দরজায় খাবার পৌঁছে দিয়েছেন কাজের বুয়া সাঈদা। সংসারে নানা ঝামেলা, স্বাস্থ্যঝুঁকি মানবিক কাজে তাকে দমাতে পারেনি। ৯ বছরের এক ছেলে, ৭ বছরের ও ৩ বছরের দুই মেয়েকেও তাকে সামলাতে হয়েছে এ দুঃসময়ে। রাহাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘করোনার এই দুর্যোগে অসুস্থ রোগীদের সহায়তা করা সকলেরই নৈতিক দায়িত্ব। আমরাও অসুস্থ হতে পারতাম। বাসায় তিনটি বাচ্চাসহ প্রতিটি মুহূর্তে উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটাতে হচ্ছে কখন কে আক্রান্ত হই। আল্লাহ সহায়। সকল রোগীই সুস্থ হওয়ার পথে। আমরাও সুস্থ আছি।’ ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ (রুমী) বলেন, ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড রোস্টার চালু করা হয়। যার কারণে হাসপাতাল লকডাউন হওয়া সত্ত্বেও দুইজন মেডিকেল অফিসার, দুইজন নার্স, একজন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার এবং একজন এমএলএসএস দ্বারা পলাশ ইউনিয়নের গোবিন্দনগর উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেছে। তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবের (ডা. বাশার) দুটি রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তাকে ছাড়পত্র দেয়া হবে। বাকিদের একটি রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে এবং দ্বিতীয় রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। রিপোর্ট নেগেটিভ হলে পর্যায়ক্রমে তাদের ছাড়পত্র প্রদান করা হবে। বর্তমানে তারা শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন।’ সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শামস উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ এবং চিকিৎসক দম্পতি আবুল বাশার মোহাম্মদ ওসমান হায়দার মজুমদার ও সুমাইয়া আরেফিন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছেন। চিকিৎসক দম্পতি আক্রান্ত হওয়ার পর এখন তাদের আমরা ছাড়পত্র দিয়ে দেব। কারণ তারা সুস্থ হয়ে গেছেন।’ তিনি আরও বলেন, তাদের মতো আমাদের সুনামগঞ্জে কর্মরত চিকিৎসকরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছেন। এটি আমাদের হাওরাঞ্চলের জন্য গর্বের।