করোনার টিকা তৈরিতে এত সময় লাগছে কেন?

করোনা ভাইরাসের (টিকা) তৈরিতে বিশ্বজুড়ে প্রতিযোগিতা চলছে। তবে এখন অবধি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এমনটাই স্বাভাবিক। কোনো কার্যকরী ও নিরাপদ টিকা তৈরি সহজ নয়। এটি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এই কাজটি করতে হয় কঠোর নিয়ম মেনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব শিগগিরই সার্বজনীন ব্যবহারের উপযোগী কোনো টিকা বাজারে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এজন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে কয়েক বছর। তবে কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, চলতি বছরই তারা কার্যকরী একটি টিকা প্রস্তুত করতে সক্ষম। এরকম সাংঘর্ষিক বক্তব্যে অনেকের মনেই বিভ্রান্তির দেখা দিতে পারে। কেউ জানে না কখন আসবে টিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড হেলথ কমিউনিকেশন ইনিশিয়েটিভের গবেষণা ও শিক্ষা বিষয়ক পরিচালক ড. সীমা ইয়াসমিন জানান, কেউ জানে না কখন কভিড-১৯ এর টিকা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞরা যখন এই বছরের মধ্যেই টিকা পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তখন তারা আসলে জরুরি প্রয়োজনে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে টিকা ব্যবহারের কথা বলেন। সম্পূর্ণরূপে অনুমোদিত কোনো টিকা টিকার কথা বলেন না। কেউ জানে না কখন কভিড-১৯ রোগের টিকা পাওয়া যাবে। কারণ, টিকা তৈরির প্রক্রিয়াটি কয়েকটি স্টেজ বা পর্যায়ে বিভক্ত। এসব স্টেজের প্রত্যেকটি সম্পন্ন করার সময় একটি আরেকটি থেকে খুবই ভিন্ন। ইয়াসমিন বলেন, তবে একটা তুলনা করে দেখা যেতে পারে। আজ অবধি সবচেয়ে দ্রুততম আবিষ্কৃত টিকা হচ্ছে মাম্পস বা গণ্ডমালারোগের। ওই টিকা তৈরি করতে লেগেছিল চার বছর। সাধারণত কোনো টিকা তৈরিতে ১০ থেকে ১৫ বছর লাগে। ১০-১২ মাসের মধ্যে করোনার টিকা তৈরি হলে সেটা বিশাল এক রেকর্ড হবে। টিকা তৈরির নানা ধাপ টিকা তৈরির প্রক্রিয়াগুলো বেশ কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ‘এক্সপ্লোর‍্যাটরি স্টেজ’ বা অনুসন্ধাত্মক পর্যায়। এই স্টেজে টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে। যেমন, কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান নিউক্লিওটাইড-ভিত্তিক টিকা তৈরির চেষ্টা করছে। এই পদ্ধতিতে টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ভাইরাসটির প্রোটিনের বদলে জেনেটিক কোড ব্যবহার করা হয়। সাধারণত, এই স্টেজ শেষ হতে দুই থেকে চার বছর সময় লাগতে পারে। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রক্রিয়াটির অগ্রগতি দ্রুত করে তুলেছে। ফলে সে সময় কিছুটা কমে এসেছে। এছাড়া, এই নভেল করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ২০০২ সালের সারস ভাইরাসের হালকা সাদৃশ্য রয়েছে। এই সাদৃশ্য গবেষকদের কাজ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। টিকা তৈরির পদ্ধতি নির্ধারণ শেষে শুরু হবে ‘প্রিক্লিনিক্যাল স্টেজ’। এই পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গঠিত কোষ ও প্রাণীদেহে সম্ভাব্য টিকাটির পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে, টিকাটি কোষ বা প্রাণীদেহে কোনো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু করে কিনা তা যাচাই করা হয়। ইয়াসমিন বলেন, যদি কোনো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না দেখা যায় বা টিকাটি যদি কোষের ক্ষতি করে তাহলে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। অর্থাৎ, ফের অনুসন্ধাত্মক পর্যায়ে ফিরে যেতে হবে। তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, এই প্রিক্লিনিক্যাল স্টেজ দ্রুত শেষ করার কনো উপায় নেই। সম্ভবত, এই স্টেজ সম্পন্ন করতে এক বছর লাগবে। প্রিক্লিনিক্যাল স্টেজে সব ঠিকঠাক গেলে শুরু হবে তৃতীয় স্টেজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস। এ স্টেজটি আবার কয়েক ধাপে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রথমে পরীক্ষামূলক টিকাটি অল্প সংখ্যক মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়। ওই ফলাফলের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের উপর এটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। একইভাবে পরবর্তীতে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের উপর। সর্বশেষ ধাপটিতে সাধারণত প্রকট সংক্রমণ হয়েছে এমন কোনো এলাকার মানুষের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। এইসব পরীক্ষা সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। কিছু জীব-নীতিশাস্ত্রজ্ঞরা অবশ্য করোনার ক্ষেত্রে এইসব কিছু পরীক্ষার ধাপ দ্রুত করে তুলতে ‘চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল’ চালানো উচিৎ। চ্যালেঞ্জ ট্রায়ালের আওতায়, গবেষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মানুষের উপর টিকাটি প্রয়োগ করবেন। অবশ্য এখন পর্যন্ত এমন কোনো পরীক্ষার অনুমোদন দেয়া হয়নি। ক্লিনিক্যাল স্টেজে সফলতা মিললে শুরু হয় নিয়ন্ত্রক পর্যালোচনার কাজ। টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি এটি উৎপাদনের অনুমতি চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে একটি লাইসেন্সের আবেদন জানায়। যুক্তররাষ্ট্রে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সাধারণত ১০ মাস লাগে। টিকাটি পর্যালোচনা করে সেটি উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স প্রদান করে থাকে খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন। তবে কভিড-১৯ এর টিকার ক্ষেত্রে এটা মোটামোটি নিশ্চিত যে, এই লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়াটি অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক দ্রুত শেষ করা হবে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। টিকাটি বিশাল সংখ্যায় উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ স্থাপনা। কখনো কখনো সেটা তৈরিতে কয়েক বছর লেগে যায়। খরচ হয় কোটি কোটি ডলার। কভিড-১৯ এর টিকা তৈরির ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া খুবই দ্রুত হবে বলেই ধারণা করা যায়। তবে টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই শত শত কোটি মানুষের জন্য টিকা উৎপাদনে প্রস্তুত থাকতে হবে। এছাড়া, টিকার সহজলভ্যতা নিশ্চিতও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। (মার্কিন সাময়ীকি ওয়ারড এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে। মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাময়িকীটির বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিক ম্যাট সাইমন।)