ভবিষ্যতে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ দুর্ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ করেছে নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এ সময় দুর্ঘটনার পেছনে ৯টি কারণ চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ ঘটনায় কে কে দায়ী তা এখন প্রকাশ করছি না। সংবাদ সম্মেলনে সুপারিশ পড়ে শোনান নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন। সুপারিশে বলা হয়েছে, সদরঘাটের কাছে নৌযানের বার্থিং বন্ধ করা, খেয়াঘাট সরিয়ে নেয়া, ভয়েজ ডিক্লারেশন বাধ্যতামূলক করা, নৌযানের গতি সীমা নির্ধারণ, পুরনো ধাঁচের লঞ্চ তুলে দেয়া, লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি বন্ধ করা এবং শাস্তি বাড়িয়ে নৌ আইন যুগোপযোগী করার সুপারিশ রয়েছে সেখানে। এ সময় ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় এমএল মর্নিং বার্ড বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি কার কী দায় পেয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে, তা প্রকাশ করেননি নৌ-পরিবহন। গত ২৯শে জুন বুড়িগঙ্গা নদীতে ময়ূর-২ নামের একটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় এমএল মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবিতে মোট ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডব্লিউটি এর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক, মাস্টারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে নৌ পুলিশ। তদন্তে হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে সেটা অবশ্যই ৩০২ ধারায় (হত্যা মামলা) আসবে জানান নৌ-প্রতিমন্ত্রী। ভবিষ্যতে নৌ দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটির ২০ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, সদরঘাট থেকে ভাটিতে সাত থেকে আট কিলোমিটার এবং উজানে তিন থেকে চার কিলোমিটার অংশে বার্থিং থাকবে না। ওই অংশে পন্টুন ছাড়া কোথাও নৌযান নোঙ্গর করে রাখা যাবে না। নদীর ওই অংশ থেকে পর্যায়ক্রমে শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে। সদরঘাট টার্মিনালের আশপাশে কোনো খেয়াঘাট রাখা যাবে না। ওয়াইজঘাটের উজানে খেয়াঘাট স্থানান্তর করা যেতে পারে। লঞ্চের সামনে, পেছনে, মাস্টার ব্রিজে, ইঞ্জিন রুমে, ডেকে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে। মাস্টারের দেখার সুবিধার জন্য ব্যাক ক্যামেরার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া লঞ্চে পর্যায়ক্রমে ওয়াকি-টকি ব্যবহার চালু করতে হবে। লঞ্চ বা জাহাজ ঘাট ত্যাগ করার আগেই ভয়েজ ডিক্লারেশন দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। লঞ্চে কতজন যাত্রী বহন করা হচ্ছে, ডেক সাইডে এবং ইঞ্জিনে কারা কারা কর্মরত, তা ভয়েজ ডিক্লারেশনে উল্লেখ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয় রাখতে হবে। সকল নদীপথে বিভিন্ন নৌযানের গতি সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। ঢাকা সদরঘাটে নৌযানের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টাওয়ার স্থাপন ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। লঞ্চে মেকানিক্যাল স্টিয়ারিংয়ের পরিবর্তে ইলেকট্রো হাইড্রলিক স্টিয়ারিং প্রবর্তন করার উদ্যোগ নিতে হবে। যাত্রীবাহী লঞ্চে মেইন ইঞ্জিনে লোকাল কন্ট্রোল সিস্টেমের পরিবর্তে ব্রিজ কন্ট্রোল সিস্টেম চালুর ব্যবস্থা নিতে হবে পর্যায়ক্রমে। ‘সাংকেন ডেক’ লঞ্চ পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে দিতে হবে। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে এ ধরনের নৌযান চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে যথাযথ সনদধারী মাস্টার ও ড্রাইভার ছাড়া নৌযান পরিচালনা করা যাবে না। ডিসপেনসেশন সনদের প্রথা বাতিল করতে হবে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ করে শিশু, নারী, বয়স্ক যাত্রীদের ওঠা-নামার সুবিধার্থে গ্যাংওয়ে বা ব্রিজ স্থাপন করতে হবে নৌযানে। সদরঘাটে পন্টুনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সার্ভের সময় নৌযানের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও অন্যান্য বিষয় দেখার জন্য পরিদর্শন কার্যক্রম আরো জোরদার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি বন্ধ করতে হবে। টিকিট দেখানো ছাড়া কোনো যাত্রীকে লঞ্চে উঠতে দেয়া যাবে না। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের সুযোগ বন্ধ করার জন্য কেবিন সংখ্যা ও ডেকের যাত্রীর সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়ে ও সকল টিকিট অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নৌ আইন অমান্যকারীদের শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ সুযোপযোগী করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নৌ কর্মীদের প্রশিক্ষণ ফলপ্রসূ করার জন্য বিআইডব্লিউটিএ কে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। নৌযানের ফিটনেস ও নৌকর্মীদের যোগ্যতা সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে আরো কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। সার্ভে সনদ প্রদানকারী সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তরে সার্ভেয়ারের সংখ্যা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পারসোনেল ট্রেনিং সেন্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার নিবন্ধিত জাহাজ ছাড়াও অনিবন্ধিত অসংখ্য জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজে গড়ে কমপক্ষে ২ জন মাস্টার ও ২ জন ইঞ্জিন চালক নিয়োগ করতে হলে প্রায় ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জাহাজে নিয়োগ করতে পারলে দুর্ঘটনা কিছুটা কমতে পারে। এ ধরনের ট্রেনিং সেন্টারের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি উপস্থিতি দৃশ্যমান করতে হবে। নৌ-দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য দায়ী মাস্টার, ইঞ্জিন ড্রাইভারদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নিতে হবে। নৌ দুর্ঘটনা ও নৌযান সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও আসামি গ্রেপ্তারের জন্য সদরঘাটে নৌপুলিশের জনবল সংখ্যা ৯ জন থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৫ জন করতে হবে। নৌযান ও নৌকর্মীদের চলাচল ও অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য নৌযান ও নৌকর্মীদের ডেটাবেজ তৈরি এবং ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যথাযথ কারিগরি সুবিধা দিতে হবে। সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। নৌ দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণার বিষয়ে একটি প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে।
মন্তব্য