তূর্ণার প্রতারণার জাল

রাহাত আরা খানম তূর্ণা। প্রতারক চক্রের নেত্রী। ঢাকায় বসে প্রতারণার জাল গড়েছিলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই চক্রে নাইজেরিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা জড়িত। ইতিমধ্যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। তাদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। তূর্ণার নেতৃত্বে প্রতারক চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা হতো প্রতারণার আট থেকে ১০ লাখ টাকা। কিছুদিন পরপরই অ্যাকাউন্ট বাতিল করে ভিন্ন নামে নতুন অ্যাকাউন্ট করা হতো। রাজধানীর দুটি এলাকায় বাসা নিয়ে এই অপকর্ম করছিলো চক্রের সদস্যরা। এই চক্রে আরো অনেকে জড়িত বলে ইতিমধ্যে তথ্য পেয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১১-২০১২ সেশনের ছাত্রী তূর্ণা মূলত উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। এই পরিচয়ে অংশ নিয়েছেন কয়েকটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও। তার নিজের গড়া প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি রয়েছে বলেই জানে সবাই। সেখানে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু এসব পরিচয়ের আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারক এই নারী। গত দেড় বছর ধরে বিদেশি চক্রের সঙ্গে মিশে নির্বিঘ্নে প্রতারণা করে যাচ্ছে। অন্যান্য অফিসের মতোই প্রতারণার অফিস খুলে বসেছিলো এই চক্র। মিরপুর-১১ এর সি ব্লকের পাঁচ নম্বর এভিনিউর ৭/৮ নম্বর বাসা ও মিরপুর-১০ এর তিন নম্বর রোডের বেনারসি পল্লীর ৩৯/ডি২, বাসায় প্রতারণার অফিস খুলেছিলো এই চক্র। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে গত ২১শে জুলাই ওই বাসা থেকেই প্রতারকদের গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। বেনারসি পল্লীর ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছিল তাদের অফিস। চতুর্থ তলায় থাকতো নাইজেরিয়ানরা আর ষষ্ঠ তলায় থাকতো রাহাত আরা খানম তূর্ণা। তূর্ণার বাসায় অবাধে আসা-যাওয়া ছিল তাদের। ওই অফিসে একেকজন আলাদা আলাদা ডেস্কে ল্যাপটপ নিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে শুধু ফেসবুকে চ্যাটিং করতো। তিনটি শিফটে ডিউটি করতো চক্রের সদস্যরা। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই ব্যস্ত থাকতো ল্যাপটপে, ফোনে। প্রতারণার কাজে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতো তারা। বিভিন্ন নামে ফেসবুকে আইডি রয়েছে এই চক্রের সদস্যদের। বিশেষ করে আমেরিকান আর্মিদের ইউনিফরম পরিহিত ছবি দিয়ে এসব আইডি খুলে চক্রের সদস্যরা। দিন রাত বাসায় বসে চ্যাট করে বন্ধুতা করে দেশে-বিদেশে। তাদের ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জারে দেখা গেছে, ইংরেজিতে লেখা এসব চ্যাটে নিজেকে আর্মি অফিসার পরিচয় দিয়ে আবেগপ্রবণ নানা কথা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বিত্তশালী নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে এই চক্র। সম্পর্কটা দ্রুত ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে জানায়, সিরিয়ায় যুদ্ধে জীবন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে। যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। পৃথিবীতে আপন বলতে তার তেমন কেউ নেই। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। তবে এই সময়ে তার কাছে যা আছে তা আপাতত ওই নারীর কাছে রাখতে চান বা তাকে গিফট করতে চান। এক পর্যায়ে ম্যাসেঞ্জারে এসব মূল্যবান সামগ্রীর এয়ারলাইন্স বুকিংয়ের ভুয়া ডকুমেন্ট পাঠায়। এরপর এসব উপহারের বক্সে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে বলেও ভুক্তভোগীকে জানায়। এভাবেই এগিয়ে যায় প্রতারণার কৌশল। এক পর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কল করে তূর্ণা। ‘হ্যালো আমি কাস্টমস কমিশনার... বলছি। আপনার একটি পার্সেল এসেছে। এতে অনেক মূল্যবান জিনিস রয়েছে। স্বর্ণ ও ডলার রয়েছে। শুল্ক পরিশোধ করে নিতে হবে।’ বিপুল টাকার গিফটের আশায় সহজেই তিন থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতেন। কেউ টাকা দিতে গড়িমসি করলে জানিয়ে দিতো, আপনার অনেক বিপদ হতে পারে। মামলা হয়ে যেতে পারে। এভাবেই ভয় দেখাতো তূর্ণা। আবার ছেলেদের সঙ্গে প্রতারণার ক্ষেত্রে ভিনদেশি নারীর নাম, ছবি ব্যবহার করে আইডি খোলা হতো। এটি পরিচালনা করতো তূর্ণা। টাকা জমা নিতে দেয়া হতো ডাচ্‌-বাংলার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের হিসাব নম্বর। সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে রাহাত আরা খানম তূর্ণা জানিয়েছে, এক একটি হিসাব নম্বরে সাত-আট জনের টাকা নেয়া হতো। তারপরই হিসাব নম্বর বন্ধ করে দেয়া হতো। বিভিন্ন জনের নামে এসব হিসাব খোলা হতো। টাকা জমা হলে সুবিধাজনক শাখা থেকে তা উত্তোলন করা হতো। নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে এক বাসাতেই থাকতো তূর্ণা। তবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে থাকতো তারা। পল্লবী থানায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র ঢাকা মেট্রো পশ্চিম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নিউটন কুমার দত্ত জানান, এটি আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র। এতে জড়িত অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। জানা গেছে, পড়ালেখা শেষে চাকরি খুঁজছিলো রাহাত আরা খানম তূর্ণা। তা প্রায় দেড় বছর আগের কথা। নিউমার্কেট এলাকায় পরিচয় হয় ডেনিস নামে এক নাইজেরিয়ানের সঙ্গে। কথা বলার একপর্যায়ে ডেনিস তাকে চাকরির প্রস্তাব দেয়। মার্চেন্ডাইজিংয়ের নামে অফিস খুলেছিলো নাইজেরিয়ান প্রতারকরা। অল্পদিনেই নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে বন্ধুতা গড়ে তোলে তূর্ণা। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে সহজেই তার ঘনিষ্ঠতা হয়। রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় এই তরুণী। তাদের প্রতারণা ব্যবসার পুঁজি সাতটি ল্যাপটপ, ২১টি বিভিন্ন মডেলের মোবাইল ফোন এবং অসংখ্য সিম। ভারতের রাজস্থান, কলকাতা, কুয়েত, আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এই চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চক্রের সদস্যরা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিন্ন পন্থায় অপকর্ম করে এই চক্রটি। গত দেড় বছর ধরে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। গত দুই মাসেই শতাধিক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৬ কোটি টাকা। জিজ্ঞাসাবাদে তূর্ণা জানিয়েছে, প্রতারণা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে তূর্ণার কাছে নাম ও নম্বর দিতো নাইজেরিয়ানরা। তা অনুসরণ করেই কাস্টমস কমিশনার সেজে কল দিতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ পরিচিত তূর্ণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে লেখাপড়া করেছে। নেত্রকোনা জেলার সদরের দক্ষিণ নাগড়ার ৪০ নম্বর বাসার আহসান উল্লাহর মেয়ে। বাবার চাকরির সুবাধে তূর্ণা বড় হয়েছে চট্টগ্রামে। গ্রেপ্তারের পর বুধবার আদালতে হাজির করা হলে ঢাকা মহানগর হাকিম মঈনুল ইসলাম তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে সিআইডি’র অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বলেন, এটি একটি পেশাদার প্রতারক চক্র। এই চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্বের পর দামি উপহার দেয়ার নামে প্রতারণা করে গত দুই মাসে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। চক্রের নাইজেরিয়ানদের প্রত্যেকের ভিসার মেয়াদ এক বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। অবৈধভাবে এই দেশে অবস্থান করে তারা অপকর্ম করছিলো বলে জানান তিনি।