বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা সমাবেশ নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল

বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে গত ১১ সেপ্টেম্বর ভোর থেকে মাছ ধরার ট্রলারে করে মিয়ানমারের সেনাদের সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ করার কথা উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। শুক্রবার গুলশানে চেয়ারপার্সন এর কার্যালয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের সেনাসমাবেশ ও বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির প্রতিবাদে বাংলাদেশ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তত তিনটি পয়েন্টে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সৈন্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের অন্তত তিন পয়েন্টে কা নিউন ছুয়াং, মিন গা লার গি ও গার খু এ ট্রলার থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সৈন্যদের নামতে দেখা গেছে। সীমান্ত পয়েন্টগুলোর মধ্যে একটির দূরত্ব আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখার (২০০ মিটার) মধ্যে। ওই তিন পয়েন্টে মাছ ধরার ট্রলারের কাঠের নিচে বসিয়ে সৈন্যদের জড়ো করা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক দিনেই এক হাজারের বেশি সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে গণহত্যা শুরুর সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঠিক একইভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সৈন্যসমাবেশ করেছিল। ফলে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ভোরে শুরু হওয়া সেনাসমাবেশের কারণে রাখাইনে এখন যেসব রোহিঙ্গা রয়েছেন, তাদের মধ্যে নতুন করে ভীতি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সন্দেহজনক গতিবিধির মাধ্যমে এ ধরণের সেনাসমাবেশ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ও মিয়ায়নমারের রাখাইনে আবদ্ধ রোহিঙ্গাদের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। একই সাথে এ ধরণের অনাকাঙ্খিত সেনা তৎপরতা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি রক্তচক্ষুর বার্তার সমতুল্য । তিনি বলেন, বিনা উসকানিতে সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিতর্কিত আন্তর্জাতিক সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ ধরণের সমাবেশ শুধু যে মিয়ানমারের নৃতাত্ত্বিক রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জন্য আতঙ্কের বিষয় তাই নয় একই সাথে এটা চলমান আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্র কর্তৃক আইন অবমাননার চূড়ান্ত বহিপ্রকাশ এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। মির্জা ফখরুল বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার তিন বছর পূর্তির প্রাক্কালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ ধরণের তৎপরতা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিক ফলাফলমাত্র। প্রায় ১২ লক্ষাধিক(গণমাধ্যমে প্রকাশিত) শরণার্থী সমস্যা সমাধানে যে ধরনের সমন্বিত বহুমুখী তৎপরতা নেয়া অত্যাবশ্যক ছিল ২০১৭ সালের আগস্টে সর্বশেষ রোহিঙ্গা সমস্যার সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন ও জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন অবৈধ সরকার তা নিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রাণলয়ের সর্বাধিক অগ্রাধিকার হওয়া সত্ত্বেও লাগাতার কূটনৈতিক ব্যর্থতায় তারা এখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তির অংশ হিসেবে গত বছরের ২২ আগস্ট তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সীমাহীন নির্লিপ্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের গণবিচ্ছিন্ন বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার শুরু থেকে দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে সমস্যাকে জটিল থেকে জটিল করে তুলেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এ সমস্যাকে দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে এডহক ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানে কার্যত মিয়াননামের পাতা ফাঁদে পা দেয়া। অথচ ইতোপূর্বে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতিতে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক মিত্রদের যুক্ত করে বাংলাদেশ দুই-দুইবার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করেছে। সরকারের সামনে সমস্যা সমাধানে এ ধরনের ঐতিহ্যগত পররাষ্ট্রনীতির সফলতা থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তার প্রতি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার চরম সংকট। ফলশ্রুতিতে এধরণের সরকারের বৈদেশিক মিশনগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের অধিক সময় ব্যয় হয় এই অবৈধ গণবিচ্ছিন্ন সরকারের টিকে থাকার স্বার্থকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। আর এর ভয়াবহ প্রভাব প্রতিফলিত হয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা সমাধানে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন পেতে সুদৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করতে না পারায়। চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বর্তমান সরকারের নির্লজ্জ নতজানু অবস্থানের মূল কারণ হয়েছে বাস্তবিক অর্থে তাদের প্রতি দেশে ও দেশের বাইরে সকলের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার সংকট। তাই এই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্ক। আর চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। কোনোভাবেই এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়’। ঠিক তখনই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এই দুই বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও চীন সহ কাউকেই আমাদের পাশে পাইনি। এমনকি সাম্প্রতিককালে আমাদের অন্যতম বিনিয়োগ অংশীদার রাশিয়াকেও আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান সরকারের এই দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণেই জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধসহ কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু চীন ও রাশিয়ার সমর্থন লাভে আমরা ব্যর্থ হই। এমনকি, তথাকথিত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সোনালী অধ্যায় চিত্রিত করতে যখন বর্তমান নতজানু সরকারের অবৈধ মন্ত্রীবর্গ নিয়ত ব্যতিব্যস্ত এরকম সময়েও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের নেয়া নিপীড়ণমূলক পদক্ষেপকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’ বলে সমর্থন করে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের সমগ্র জনগণকে গভীরভাবে হতাশ করেছিল । তিনি বলেন, পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থী শিবির এই মুহুর্তে বাংলাদেশে। একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মিয়ানমার সরকারের সক্রিয় নীতিপরিকল্পনার অংশ হিসেবে যে রোহিঙ্গা সমস্যার সৃষ্টি সেটা কোনো অর্থেই বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হতে পারে না। এটা নিঃসন্দেহে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক বিপর্যয়। এর সর্বাত্মক দায় মিয়ানমার। আর বাংলাদেশ এর অন্যতম প্রধান পক্ষ। তাই এ সমস্যা সমাধানে শুরু থেকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বহুপক্ষীয় উদ্যেগকে সাথে নিয়ে সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী ছিল। কিন্তু লাগাতারভাবে একনায়ক রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে বিরোধীদের উপর সীমাহীন নির্মম দমন-পীড়ন ও ৩০ ডিসেম্বরের মতো মধ্যরাতের নির্বাচনের বিতর্কিত বিষয়গুলো কারণে বহির্বিশ্বে শেখ হাসিনা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তা ফিরে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায়ই আমাদের দলবাজ কূটনীতিকদের বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে অগ্রাধিকার বিষয় হওয়া বাঞ্চণীয় ছিলো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধান। সরকারের সামগ্রিক কার্যকলাপ বিবেচনায় এধরনের অগ্রাধিকার সর্বতই অনুপস্থিত। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এই সমস্যার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী কোনো বিশ্ব নেতার সাথে সাক্ষাত করেননি, বিশ্ব সফর করেননি এবং জাতিসংঘে সেইভাবে গুরুত্বসহকারে বিষয়টাকে তুলে ধরতে পারেননি। যার ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমরা বৈশ্বিক,আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক সকল স্তরেই ব্যর্থ হচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সুযোগে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান আজ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের এ দুর্বল নীতি আজ মিয়ানমার সরকারের কাছেও স্পষ্ট। এর পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেই মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ অযাচিত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে সেনাসমাবেশ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পক্ষ থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এহেন সেনা সমাবেশের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। এছাড়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ ধরনের অপতৎপরতা রুখতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণপূর্বক আন্তঃআঞ্চলিক কূটনৈতিক উদ্যেগ গ্রহণে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বর্তমান নতজানু সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।