করোনায় মৃত্যু অর্ধেকের বেশি ঢাকায়

মহামারি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত গত ১০ মাসে দেশে মোট ৫ লাখ ১৭ হাজার ৯১২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৬৭০ জনের। মৃত্যুর মোট সংখ্যা অর্ধেকের বেশি ঢাকা বিভাগে। আর সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে। জানা যায়, দেশে গত বছরের ৮ই মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১৮ই মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়। তখন আক্রান্ত ও নিহতরা ছিলেন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের। পরে ৫ই এপ্রিল পাঁচটি জায়গাকে সংক্রমণের ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল আইইডিসিআর। এসব এলাকাগুলো হচ্ছে রাজধানীর টোলারবাগ, বাসাবো, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুরের শিবচর এবং গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর। এরপর ধীরে ধীরে সারা দেশে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমণের প্রথম মাস থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অনিয়মিত। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতিদিনই করোনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উঠানামা করেছে। তবে গত বছরের ৩০শে জুন দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে। এদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে অর্ধেকই ছিল রাজধানী ঢাকার এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার। ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, মৃত্যুর মোট সংখ্যার অর্ধেকের বেশি ঢাকা বিভাগের। এখানে করোনায় মারা গেছেন ৪ হাজার ২২৩ জন। মৃত্যুর হার ৫৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম বিভাগ। মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ৪১৮ জন, মৃত্যুর হার ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে খুলনায় ৫৩৭ জন। চতুর্থ স্থানে রাজশাহী। করোনায় এই বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ৪৪১ জন। পঞ্চম স্থানে রংপুরে ৩৪৬ জন। সিলেটে ২৯৪ জন। বরিশালে ২৩৮ জন। সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে ১৭৩ জন। মোট আক্রান্তের ২ দশমিক ২৬ ভাগ। নারী-পুরুষ বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনায় সবচেয়ে বেশি পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এই সময়ে ৫ হাজার ৮৩১ জন পুরুষের মৃৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর হার ৭৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আর ১৮৩৯ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃত্যুর হার ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। করোনায় মৃত ব্যক্তিদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট মৃত্যুর মধ্যে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মৃত্যুর হার ছিল ৪৪ শতাংশ। বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব মানুষের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়েছে। তাদের সংখ্যা ৪১৯০ জন। মৃত্যুর হার ৫৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৯৪৮ জন। শতকরা ২৫ দশমিক ৪০ ভাগ। ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৮৯৭ জনের। মৃত্যুর হার ১১ দশমিক ৬৯ ভাগ। ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৮২ জনের। শতকরা ৪ দশমিক ৯৮ ভাগ। ২১ থেকে ৩০-এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৬০ জনের। শতকরা ২ দশমিক শূন্য ৯ ভাগ। ১১ থেকে ২০-এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫৭ জনের। শতকরা দশমিক ৭৪ শতাংশ। শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী মৃত্যু হয়েছে আরো ৩৬ জনের। শতকরা দশমিক ৪৭ শতাংশ। ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে করোনা বিষয়ক তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি দশ লাখে ৩ হাজার ৪১ জনের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর প্রতি দশ লাখে প্রায় ৪৫ জন ব্যক্তি করোনায় মারা গেছেন, আর সুস্থ হয়েছেন ২৭১৫ জন। ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত মোট করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৬২ হাজার ৪৫৯ জন। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়ালো ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৫টি। গত বছরের জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। ওই মাসে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। অক্টোবরে গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন ২২ জন। নভেম্বরে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ জন। নভেম্বর মাস থেকে ডিসেম্বর মাসে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেড়েছে। ডিসেম্বর মাসে মৃত্যু হয়েছে ৯১৫ জনের। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নভেম্বর মাসের তুলনায় ডিসেম্বর মাসে মৃত্যু বেড়েছে ২৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের করোনা বিষয়ক ওয়েবসাইটে ‘কোভিড-১৯ ট্র্যাকার’ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ঢাকা জেলায় আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার ৬২৯ জন। ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৮ হাজার ২৯০ জন, ফরিদপুর জেলায় ৭৯৮১ জন, গাজীপুরে ৬ হাজার ৬৯৪ জন, সিরাজগঞ্জে আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২৫১ জন, কিশোরগঞ্জে ৩ হাজার ৩৪১ জন। এদিকে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। তবে রাজধানী ঢাকায় জীবনযাত্রা অনেকটা মহামারির শুরুর আগের পর্যায়ে চলে এসেছে। সর্বত্রই বেড়েছে জনসমাগম। রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, অফিস, সভা-সমাবেশে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব। খুব কম মানুষ মাস্ক পরে রাস্তায় বের হচ্ছেন। জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলমান রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনার সংক্রমণ আরো বাড়বে। আইইডিসিআর’র পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ঢাকায় জনবসতির কারণে সংক্রমণ বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুও। করোনায় আক্রান্ত হলে সারা দেশ থেকে ঢাকায় এসে হাসপাতালে ভর্তি হন। ফলে এখানে সংখ্যাটা একটু বেশি হয়। কোথাও সঠিক ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি দুর্বল। এতে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো ব্যক্তির করোনা শনাক্ত হলে তাকে আইসোলেশনে না নেয়ার ফলে আশেপাশে থাকা মানুষের মধ্যে কোভিড ছড়িয়ে পড়ছে। সংক্রমণ রোধ করতে হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে নিতে হবে। তাকে সকল প্রকার সাহায্য- সহযোগিতা করতে হবে। যাতে সে আইসোলেশনে থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তাহলে ঢাকাসহ সারা দেশে সংক্রমণ কমবে বলে তিনি মনে করেন।