শান্তির সমাজ বিনির্মাণে চাই চেতনার বিপ্লব

গোটা পৃথিবীতে ধর্ষণের মহামারি চলছে যেন। নারীরা কোনো জায়গাতেই নিরাপদ নয়। বাদ পড়ছে না ছোট ছোট মেয়ে শিশুরাও। দেশের প্রধানসারির একটি গণমাধ্যম ধর্ষণের পরিসংখ্যানে বলেছে, গত বছর ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ৭২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি। পুলিশের হিসাব বলছে, গত বছর ধর্ষণের কারণে ১২ শিশু এবং ২৬ জন নারী মারা যান। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ২১ নারী ও ১৪ শিশু। মামলা হয়নি বা লোক চক্ষুর আড়ালে চাপা পড়ে গেছে এমন ধর্ষণের ঘটনাও তো কম নয়। শুধু ধর্ষণই বলছি কেন। সবধরনের অপরাধে ছেয়ে গেছে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবী। আগামী পৃথিবীর কাণ্ডারি যারা হবেন, দেশ ও জাতির নেতৃত্ব যারা দিবেন, সেই যুবসমাজও জড়িয়ে পড়ছে নানারকম অপরাধ কর্মে; যা আমাদের জন্য একটি অশনিসঙ্কেত। এর একটি সমাধান এবং এই অপরাধপ্রবণতা রোধ করা বর্তমান সময়ের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু এটি করা হবে কীভাবে? আইন প্রণয়ন করে? শাস্তি দিয়ে? অনেকেই মতামত দিচ্ছেন,ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হোক। কেউ বলছেন, ধর্ষককে গুলি করে মারা হোক। কেউ বা বলছেন পাথর নিক্ষেপ করে মারা হোক। নানাজন নানা মত দিচ্ছেন। মনে রাখা দরকার, কেবল আইন করেই সমস্ত অপরাধ বন্ধ করা যায় না। ভারতের প্রখ্যাত একজন গবেষক আলেম মাওলানা সাজ্জাদ নোমানি সম্প্রতি মুম্বাইয়ের একটি কনফারেন্সে এ বিষয়ে চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মানুষের মন-মেজাজ ঠিক না করে কেবল আইন করে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। একটি উদাহরণ টেনে মাওলানা সাজ্জাদ নোমানি বলেন, জজ ওয়াশিংটনের সময়ে পুরো আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ করা হল। এরপরে দেখা গেল, আগে তো মদ বিক্রি করা হতো সরকারি লাইসেন্স নিয়ে। আর এখন লাইসেন্স ছাড়াই গোপনে আরও অধিকহারে বিক্রয় শুরু হয়ে গেছে। আসলে বিষয়টি এরকমই। কেবল আইন করেই অপরাধ রোধ করা সম্ভব নয়। মানুষের ভেতরে মন্দ জিনিসের প্রতি আগে যদি ঘৃণা সৃষ্টি করা না যায়, সামাজিকভাবে এবং মানসিকভাবে যদি মন্দ জিনিসের মন্দ দিকগুলো স্পষ্ট করা না যায়, তাহলে শত চেষ্টা করেও অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বিশ্ব নবীজির (সা.) কর্মপন্থা অনুসরণীয় হতে পারে; যা প্রতিটি যুগে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সাড়ে ১৪শ' বছর আগে আরব দেশে মদপান ছিল স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ঘরে ঘরে মদপান করা হতো। কিন্তু নবীজি (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন তখন এই ব্যাপক প্রচলিত মদকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। শুধু নিষিদ্ধই নয়, মদকারীর জন্য শাস্তিও নির্ধারণ করলেন। সমাজ তা সাদরে গ্রহণও করেছিল। কিন্তু, সেই নিষিদ্ধ করণের পদ্ধতিটা কেমন ছিল একটু লক্ষ করুন। নবীজি (সা.) প্রথমেই মানুষের মন-মেজাজের পরিবর্তন করলেন। ব্যাপক প্রচলিত মদের প্রতি ধীরে ধীরে মানুষের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করলেন। এরপরে তা নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করলেন। মদ নিষিদ্ধের আগে মানুষ নবীজির (সা.) কাছে আসতো মদের হুকুম সম্পর্কে জানার জন্য। সবাই চাচ্ছিল সামাজিকভাবে মদ যেন নিষিদ্ধ করা হয়। এটা কেন হয়েছিল? কারণ, নবীজি (সা.) মদকে সরাসরি নিষিদ্ধ করার আগে মানুষের মন-মেজাজ তৈরি করেছেন। মদের খারাপ দিকগুলো তাদের মনে গেঁথে দিয়েছেন। এরপরে কুরআনের আয়াত নাজিল করে নবীজিকে বলে দেওয়া হলো- লোকেরা আপনার কাছে মদ ও জুয়ার ব্যাপারে জানতে চায়, আপনি তাদের বলে দিন, এই দুই জিনিসে অনেক ক্ষতি রয়েছে। তবে কিছু উপকারিতাও আছে। দেখুন,মানুষ নবীজির (সা.) কাছে এসেছিল মদকে হারাম করানোর জন্য, কিন্তু তিনি সরাসরি হারাম না বলে বললেন, মদ আর জুয়ার মধ্যে মানুষের অনেক ক্ষতি রয়েছে। তবে কিছু উপকারিতাও আছে। কারণ, তৎকালীন সময়ে এরকম একটি প্রচলন ছিল যে, অনেক মানুষ জুয়া খেলতো কেবল একারণে যে, জুয়া থেকে যেই পয়সা উপার্জন হতো, তা গরিব অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দিত। তাই, ইসলামে জাকাতের বিধান আসার আগে জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এর কিছুদিন পর আশ্চর্য একটি ঘটনা ঘটলো। লোকেরা নামাজে দাঁড়ালো। যিনি নামাজ পড়াচ্ছিলেন তিনি কুরআনের আয়াতের মধ্যে মারাত্মক পর্যায়ের ভুল পড়লেন। সুরা ইখলাসও ভুলে গেলেন। একটি আয়াতও পড়তে পারছিলেন না। তার কারণ হল, তিনি মদ পান করে নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন মাথা আউলে গেছে। লোকেরা দৌড়ে নবীজির (সা.) কাছে হাজির হল। আরজ করলো, হে আল্লাহর রাসূল, মদের কারণে আমাদের নামাজ পর্যন্ত বরবাদ হয়ে যাচ্ছে। আপনি মদকে নিষিদ্ধকরণের ব্যবস্থা করুন। তখনও নবীজি (সা.) পবিত্র কুরআনের আয়াত পড়লেন, ‘তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজে দাঁড়িও না।’ নামাজের কারণে মদ কে ছেড়ে দাও এ কথা বলেননি। বলেছেন, মদ পান করে নামাজ পড়ো না। এমনটা কেন করেছিলেন? করেছিলেন মানুষকে অপকারী ও মন্দ জিনিসের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য। আইন কীভাবে কখন প্রয়োগ করা হবে তা তালিম দেওয়ার জন্য। একটি প্রবাদ কথা আছে- প্রথমে তাওয়াকে গরম করতে হয়। এরপরে তাতে রুটি ভাজতে হয়। লোহা আগে গরম করে এরপরে হাতুড়ি মেরে তাকে যা বানাতে চান বানাতে হয়। ঠাণ্ডা লোহায় হাতুড়ি মারবেন, তো আপনিই আহত হবেন। ঠিক তেমনই আগে মানুষের মন-মেজাজ এবং মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে পবিত্র করতে হবে। ভেতরে অপরাধবোধ জাগ্রত করতে হবে। মন্দ জিনিসকে মন্দ বলা শেখাতে হবে। এরপর করতে হবে আইন প্রণয়ন এবং শাস্তির ব্যবস্থা।