গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য দিরাই-শাল্লার চার গ্রাম

সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লা উপজেলার ৪টি গ্রামের নারী ও শিশুরা খাদ্যের অভাবসহ রয়েছে নানান সমস্যায়। গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য দিরাই উপজেলার নাচনী, চন্ডিপুর ধনপুর এবং শাল্লা উপজেলার কাশিপুর।  

জানা যায়, ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে গত ১৭মার্চ শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে দিরাই উপজেলার নাচনী, চন্ডিপুর, ধনপুর ও শাল্লা উপজেলার কাশিপুর গ্রামের কিছু  লোকজন হামলা করে। এতে নোয়াগাঁও গ্রামের কয়েকটি বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র ভাঙচুর হয়।

এ নিয়ে গত ১৮মার্চ রাতে শাল্লা থানায় দু’টি মামলা হলে দিরাই উপজেলার নাচনী, চন্ডিপুর, ধনপুর ও শাল্লা উপজেলার কাশিপুর গ্রামের পুরুষেরা গ্রেফতার এড়াতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরইমধ্যে ঘটনার মূলহোতা স্বাধীন মেম্বারসহ ওইসব গ্রামের ৪০জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ  আটক করে জেলে পাঠিয়েছে।
 
ওইসব গ্রামের পুরুষেরা পালিয়ে থাকায় তাদের পরিবারে দেখা দিয়েছে খাদ্যের অভাবসহ নানা সমস্যা। সরজমিনে দেখা যায়, গ্রামগুলো রয়েছে পুরুষ শূন্য। বাড়িতে দেখা যায় শুধুমাত্র নারী ও শিশুদের। পুলিশের ভয়ে তাদের বাড়িতে আসছে না কোনো আত্মীয়-স্বজনও।

নাচনী গ্রামের রত্না   বেগম  বলেন, আমার ঘরে কিছু হাঁস-মুরগী ছিল তা বিক্রি করে এ কয়দিন চলছি। পরে কি করব জানি না। আমার স্বামী কোথায় পালিয়ে আছে তাও আমি জানি না। ওইগ্রামের আছিয়া খাতুন বলেন, আমরার কেউ ইতাত গেছইননা, তারা বাড়িতেও আছলানা। পুলিশের ডরে বাড়ি ছাইরা গেছইন। আমরা বড় অভাবের মাঝে আছি।

নোয়াগাঁও হামলার মূল হোতা মোঃ শহীদুল ইসলাম স্বাধীন মেম্বারের মা খুুুুদেজা বিবি( ৬৫)  বলেন, আমার ছেলে স্বাধীন অপরাধী হলে তার বিচার হোক। কিন্তু আমার নিরপরাধ ছেলে আলফু মিয়া বাড়ির বাইরে মারা যায়। তার লাশ নিয়া বাইরের ৫-৬জন মানুষ আসে। পরে চেয়ারম্যানের কথায় তারা আমার ছেলের লাশ পুরান ধারি ও পুরান বাঁশ দিয়া দাফন করে।

তিনি কেঁদে কেঁদে আরো বলেন, আমার ছেলেরে মাটি দেয়ার মানুষ পাইলাম না। সেতো কোন দোোষ করেনি।
এদিকে ওইসব গ্রামের মহিলারা জানান, আমরা টাকা-পয়সার অভাবে খেতে পারছি না, বাচ্ছাদের অসুখে ঔষধ কিনতে পারছি না। আমরা অনেক বিপদ ও সমস্যা আছি। গত ২৫মার্চ নোয়াগাঁও গ্রামের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এসেছিলেন।

আমরা তার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দেখা করতে পারিনি। আমাদের সমস্যাগুলোও সরকারকে জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। আমরা অবলা নারী ও আমাদের শিশুরা খাদ্যের অভাবসহ চিকিৎসার অভাবে রয়েছে এবং রাতের বেলাতে আমরা নিরাপত্তার অভাববোধ  করছি। সত্তর বছর বয়সী আলফুমা বিবি বলেন আমার ছেলে জামাল উদ্দিন অনেক দিন বাড়ি ছাড়া তার বাচ্চাদের ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছি। সে কোন মারামারির ঘটনার সাথে জড়িত না কিন্ত পুলিশের ভয়ে এলাকা ছাড়া।

কোথায় আছে তাও জানিনা। সে ঘটনার দিন ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল  চালে টিন লাগানোর কাজ করছিল। গ্রামের মানুষের দাবী ঘটনার সুষ্ট তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচার করা হোক। নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ কে যেন হয়রানী না করা হয়, সেই ব্যাবস্থা  নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের নিকট দাবী জানাই।
শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম কর্তা নাজমুল হক জানান হয়তো সবাই অপরাধ করেনি কিন্ত তদন্তের আগে কিছুই বলা সম্ভব না। তবে নিরপরাধ মানুষ হয়রানীর শিকার হবেনা তা ঐ সব গ্রামের নারী শিশুদের বলেছি।

জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বিপিএম বলেছেন, সুনামগঞ্জে অতীতেও কোন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ কে হয়রানী করা হয়নি, এমন উদাহরণ নেই। মামলাটি তদন্তাধীন আছে, তদন্তের পর বলতে পারা যাবে কে দোষী কে নির্দোষ। যারা দোষী প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পত্র দেয়া হবে। আনুমানিক ভাবে একটা সংখ্যার উল্লেখ থাকায় সবাই পলাতক আছে ।
 
প্রসঙ্গত,  গত ১৫   মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় হেফাজত ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হক তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এনিয়ে শাল্লার নোয়াগাও গ্রামের এক যুবক ঝুমন দাস আপন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মামুনুল হক কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। পরে এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা মন্তব্য এবং এক পর্যায়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। হেফাজত ঝুমন দাস আপনের গ্রেফতার দাবী করে রাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। ১৬ মার্চ রাত গভীরে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

পরদিন ১৭ মার্চ সকালে নোয়াগাঁও গ্রামের পার্শ্ববর্ত কয়েকটি গ্রামের মানুষ ঝুমন দাস আপনের গ্রাম নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালায় কিছু ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এ ঘটনায় পুলিশ ও একজন ইউপি চেয়ারম্যান বাদী হয়ে ৫০ জনের নাম উল্লেখ সহ  দেড় হাজার মানুষের নামে মামলা করলে গ্রেফতার আতঙ্কে  ৪ গ্রামের পুরুষ মানুষ পলাতক থাকে।