তাহাজ্জুদের অভ্যাস গড়ে উঠুক রমজানে

রমজান মাস তাকওয়া অর্জনের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। রমজান মাস আগমনের সাথে সাথে পৃথিবীতে যেন ইবাদতের বসন্ত শুরু হয়ে যায়।সারাবছর অনেকে পরিপূর্ণ ইবাদতব-বন্দেগি না করলেও এই মাসে কম বেশি সব মুসলমান  আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে। 

মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, বনি আদমের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যেই- সাওম ব্যতীত। তা আমার জন্য, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেব। আর সাওম পালনকারীদের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের ঘ্রাণের চেয়ে অধিক সুগন্ধযুক্ত। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৯২৭)


রমজান মাসকে ফলপ্রসূ করতে মুসলমানরা ফরজ,সুন্নত এবং বিভিন্ন নফল ইবাদত করে থাকে। রমজান মাসে তাহাজ্জুদ নামাজ কায়েমের সুবর্ণ  সুযোগ তৈরি হয় প্রত্যেক মুমিনের জন্য। 

রাসুল (সা.) তাহাজ্জুদের সালাত সম্পর্কে বলেছেন, ফরজ সালাতসমূহের পর সবচেয়ে উত্তম সালাত হলো রাতের সালাত বা তাহাজ্জুদ সালাত। (মুসলিম) 

নবীজি (সা.) নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতেন, তাই এটি সুন্নত, অতিরিক্ত হলে নফল। 
তাহাজ্জুদ অর্থ ক্লেষ-কষ্ট,শ্রম-পরিশ্রম। রাতে ঘুমানোর পর মধ্য রাতে অর্থাৎ রাতের দুই-তৃতীয়াংশে শয্যা ত্যাগ করার নাম তাহাজ্জুদ। মহামহিম আল্লাহ্তায়ালার নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো তাহাজ্জুদ। 

আল্লাহ বছরের বিশেষ দিনগুলোতে সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে নেমে আসেন। এছাড়াও প্রতি রাতের দুই-তৃতীয়াংশে আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার প্রথম আসমানে নেমে আসেন বান্দার ফরিয়াদ শুনার জন্য। 

আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, এটা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য; আশা করা যায় তোমার রব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে। (সূরা বনি ইসরাইল-৭৯)

রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাহাজ্জুদের সময়। সাহরির সময় শেষ হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্তও শেষ হয়ে যায়। 

রাসুল (সা.) এর সময় তাহাজ্জুদের জন্য আলাদা আজান দেওয়া হতো।এখনো মক্কা ও মদিনা শরীফে এ নীতি প্রচলিত আছে। তাহাজ্জুদ একাকী পড়াই উত্তম। 

কারণ অনেক মুহাজিদ ফিকহগন জামায়াতে তাহাজ্জুদ পড়াকে মাকরূহ বলেছেন। তাই অন্য সব সুন্নত ও নফল সালাতের মত তাহাজ্জুদ সালাতেও সূরা কেরাআত নিম্ন স্বরে পড়তে হয় এবং এর জন্য ইকামাতের প্রয়োজন হয়না।

স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য ডেকে তোলা সুন্নাত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্ সেই স্ত্রীর প্রতি রহমত করেছেন, যে নিজে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগায়।যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে যেন তার মুখমন্ডলে পানির ছিটা দেয়। (আবু দাউদ ও নাসারী)

রাসুল (সা.) তাহাজ্জুদ সালাতের মাধ্যমে গভীর ধ্যানে নিমজ্জিত হতেন। এমনকি নিজের শরীরের প্রতিও কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকতো না।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) রাতে সালাত আদায় করতেন; এমনকি তার পা ফুলে যেতো। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এতো কষ্ট করেন কেন? অথচ আল্লাহ্ আপনার পূর্বের ও পরের সব গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি কী কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? তার মেদ বর্ধিত হলে  তিনি বসে সালাত আদায় করতেন। যখন রুকু করার ইচ্ছে করতেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে কিরাআত পড়তেন, তারপর রুকূ‘ করতেন। (সহিহ বুখারী: ৪৮৩৭)


তাহাজ্জুদের প্রতি হজরত রাসূল (সা.)-এর তীব্র আকর্ষণ বিবৃত হয়েছে পবিত্র কোরআনেও। রাসূল (সা.) সারারাত তাহাজ্জুদে কাটিয়ে দিতেন। 

তাই আল্লাহতায়ালা পরম মমতায় কুরআনে বলেছেন, হে বস্ত্রাবৃত! রাত জাগরণ কর কিছু অংশ ব্যতীত।অর্ধ রাত কিংবা তদপেক্ষা কিছু কম।অথবা তদপেক্ষা বেশি। আর কোরআন আবৃত্তি কর ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দর ভাবে। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয়ই রাতে জাগরণ ইবাদতের জন্য গভীর মনোনিবেশ, হৃদয় সঙ্গম এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। দিনে তোমাদের জন্য রয়েছে কর্মব্যস্ততা। (সূরা মুযম্মিল:১-৭)

হজরত আলি ইবনে আবি তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, এক রাতে রাসুল (সা.) তার ও ফাতেমার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাদেরকে ডেকে বলেন, তোমরা নামাজ পড়বে না।

রাসুল(সা.) শুধু পরিবারকেই উদ্বুদ্ধ করতেন না; বরং তার সাহাবিদেরকেও রমজানে তাহাজ্জুদ আদায়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে তাহাজ্জুদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। তবে তিনি আবশ্য পালনীয় বিষয় হিসেবে নির্দেশ দেননি। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও নিষ্ঠার সঙ্গে রমজানে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করবে, আল্লাহতায়ালা তার পূর্ববর্তী পাপ মার্জনা করবেন। (সুনানে নাসায়ি: ২১৯৭)

তাহাজ্জুদ দুই দুই করে চার রাকাত, আট রাকাত,বারো রাকাত এভাবে কম বা বেশিও পড়া যায়। তাহাজ্জুদ সালাতের রুকু সিজদাহ্ লম্বা করা সুন্নত। 

হাদিসে এসেছে, রাসূল (সাঃ) তাহাজ্জুদ সালাতে এক একটি সিজদা এত পরিমাণ করতেন যে,কেউ (সিজদা হতে) তার মাথা তোলার পূর্বে পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত করতে পারত।(সহীহ বুখারী-১১২৩)

রমজান মাসে তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। বছরের অন্য মাস বা দিনগুলোতে  রাতে ঘুমানোর পর ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়াটা কষ্টকর হওয়ায় অনেকেই তা পড়তে পারিনা। 
কিন্তু রমজান মাসে ফরজ সওম আদায়ের উদ্দেশ্যে সাহরি খাওয়ার জন্য গভীর রাতে উঠতে হয়, সেই সুবাদে তাহাজ্জুদের নামাজ  পড়াটাও সহজ হয়ে যায়। 

রমজান মাসে নিয়মিত  তাহাজ্জুদ পড়লে একদিকে যেমন অনেক ফজিলত পাওয়া যায়, তেমনি এটি একটি অভ্যাসে পরিণত হয়। 

যার ফলে পরবর্তী মাসগুলোতেও তাহাজ্জুদ সালাত পড়াটা অনেকাংশে  সহজ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে  প্রতিদিনই আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হতে পারবো।