দেশ-বিদেশে সংকটে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা

তিন বছর আগে ঋণ করে ও জমি বিক্রি করে দুবাই যান কুমিল্লার সাজ্জাদ হোসেন। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর তার চাকরি চলে যায়। ৫ মাস হলো তিনি দেশে ফিরেছেন। ২ বছরে যা আয় করেছিলেন তা দিয়ে ঋণই পরিশোধ করতে পারেননি। হাতে যতটুকু অর্থ ছিল তা ঘরে বসে খেয়ে শেষ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে পুনরায় তিনি বিদেশে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে দেশেই চাকরি খুঁজতে থাকেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারেননি সাজ্জাদ। এ অবস্থায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে হতাশায় দিন কাটছে তার।

করোনায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গত বছর গ্রামে চলে আসেন কাতার প্রবাসী আশরাফুল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার অপেক্ষায় ঘরে বসে খেয়ে সঞ্চয় করা টাকাও প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। এখন বিদেশে যাওয়া নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তায় পড়েছেন, তেমনি দেশে থেকেও কোনো কাজের সন্ধান পাচ্ছেন না আশরাফুল। শুধু সাজ্জাদ কিংবা আশরাফুল নন, করোনাকালে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এমন হাজারো প্রবাসীরা বিপদের মুখে পড়েছেন। কেউবা আবার বিদেশের মাটিতেই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগ নিলেও তার সুফলও মিলছে না। অথচ করোনাকালেও প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতিকে ধরে রেখেছেন। রেকর্ড রেমিট্যান্স আসায় রিজার্ভেও একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে।সম্প্রতি ব্র্যাক, ইউএন ওমেন ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বছর এপ্রিল থেকে নভেম্বরে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের প্রায় ৭৭ শতাংশ হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজেছেন। এসব প্রবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে ৬১ ভাগেই দেখা গেছে তাদের অন্তত একজন সদস্য মহামারির কারণে চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। এছাড়া সম্প্রতি ব্র্যাকের আরেকটি জরিপে এসেছে- বছর পেরিয়ে গেলেও ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের ৪৭ শতাংশই এখনো আয়ের জন্য কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেননি। দৈনন্দিন খরচ চালাতে অনেককেই পরিবারের আয় বা আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। অন্যদিকে ৫৩ শতাংশ কৃষি কাজ, ছোটখাটো ব্যবসা বা শ্রমিক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করে বর্তমানে পরিবার চালাচ্ছেন। আর বিদেশফেরত এসব প্রবাসীর ৯৮ শতাংশই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাকালে চাকরি চলে যাওয়ায় কিংবা কোম্পানি বেতন আটকে দেয়ায় বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা বিপদের মুখে পড়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো মতে দেশে ফিরেছেন, কেউবা বিদেশের মাটিতেই খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ দেশে ফিরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত পুনরায় বিদেশে যেতে পারেননি। আবার কেউ এমনও আছেন যারা পুনরায় বিদেশে যাওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে দেশেই চাকরি খুঁজছেন। কিন্তু অনেকেই কাজ না পেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।

বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা রকম কাজে যুক্ত ছিলেন। করোনায় অনেক দেশেই এসব কাজের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। তাদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে শুধু ফেরত আসা শ্রমিকই নন, পরিবারের অন্য সদস্যরাও সংকটে পড়েছেন। জানা যায়, ফেরত আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনে ইতিমধ্যে সরকার ২০০ কোটি টাকার ঋণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বরাদ্দকৃত অর্থের মাত্র ৫ শতাংশের কম বিতরণ হয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের বড় একটি অংশ এই ঋণ সুবিধা সম্পর্কে জানেনও না। বিদ্যমান প্রণোদনা মূলত ব্যাংকিং চ্যানেল ও শর্তভিত্তিক ঋণ হওয়ার কারণে অনেকেই এই সুবিধা নিতে পারছেন না।

সৌদি থেকে দুই মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিলেন সৌদি প্রবাসী রাজশাহীর আমিনুল ইসলাম। ছুটি শেষ হলেও বিভিন্ন জটিলতায় এখন পর্যন্ত সৌদি যেতে পারেননি। ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও নতুন করে সংকটে পড়েছেন তিনি। সৌদি সরকারের নতুন নিয়মের কারণে তাকে সৌদি ফিরে গিয়ে ৭ দিন নিজের খরচে হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। বাংলাদেশ থেকে একবার করোনা টেস্ট করে কোয়ারেন্টিনে থাকার পরও সৌদিতে করতে হবে দু’বার করোনা টেস্ট। সব মিলিয়ে সৌদি যাত্রায় তাকে গুনতে হবে আরো কমপক্ষে ৫৫ হাজার টাকা। এই বাড়তি খরচের চিন্তাও তাকে করতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে রয়েছে কর্মক্ষেত্রের নিশ্চয়তা। এমন পরিস্থিতিতে তাকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। তিনি বলেন, যা ইনকাম করেছিলাম তা এই কয়েকদিনে খেয়ে পড়ে শেষের দিকে। আবার যেতে হলে কিছু ঋণ করে তারপর যেতে হবে। এরমধ্যে আবার বাড়তি খরচ। আবার সৌদি গিয়েও চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করে। এ অবস্থায় পরিবারের মানুষও বলছে আর বিদেশে যেতে হবে না, দেশে থেকেই একটা কিছু করতে বলছে তারা। কিন্তু দেশে থেকেই বা কি কাজ করবো সেটাও ভাবছি। দেশে ভালো ইনকাম করতে না পেরেই বিদেশে গেছি। এখনতো পরিস্থিতি আরো খারাপ। এ অবস্থায় দেশে কাজ পাওয়া খুবই মুশকিল। তাই কি সিদ্ধান্ত নেবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। তিনি বলেন, সরকারি ঋণের কথা শুধু শুনি। কিন্তু কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় সেটা পাওয়া যাবে সেটাতো আমি জানি না।

কুমিল্লার দুবাই প্রবাসী সাজ্জাদ বলেন, জমি বিক্রি করে, ঋণ করে অভাব মোচনের স্বপ্ন নিয়ে ২০১৮ সালে বিদেশ যাই। দুই বছর লেগেছে শুধু ঋণ শোধ করতে, আরও কিছু বাকি আছে। এমন অবস্থায় যখন কিছু টাকা সঞ্চয় করতে শুরু করেছি তখন মহামারি শুরু হয়। প্রথমে কোম্পানি বেতন কমিয়ে দেয়। এর কিছুদিন পর একসঙ্গে অনেক কর্মী ছাঁটাই করে তারা। পরে উপায় না পেয়ে দেশে চলে আসি। এখন যে পরিস্থিতি তাতে বিদেশে যাওয়ার আর চিন্তা করছি না। দেশেই একটা কিছু করে কোনোমতে পরিবার নিয়ে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে হবে। ছোটখাটো চাকরির জন্য চেষ্টা করেছি কিন্তু পাইনি। কারো থেকে কোনো সহযোগিতাও পাইনি।