আবু ত্ব-হার স্ত্রীর আকুতি

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত নিখোঁজ ইসলামী বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেছেন তার স্ত্রী সাবিকুন্নাহার। বুধবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্বামীর সন্ধান দাবি করেন। বলেন, আমি বিশ্বাস করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে দুই ঘণ্টার মধ্যে আমার স্বামীর সন্ধান দিতে পারবেন। যদি দিতে না পারেন অন্তত আমাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমি আর পারছি না, শারীরিক ও মানসিকভাবে আমি বিপর্যস্ত।
একসময়কার তুখোড় ক্রিকেটার আফসানুল আদনান ত্ব-হা। রংপুরের ক্রিকেট অঙ্গনে সবার পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি। রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন তিনি।

স্নাতকে পড়ার সময় থেকেই ধর্মের প্রতি তাঁর ঝোঁক বাড়তে থাকে। বাবার মৃত্যুর পর রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোডের নানার বাড়িতে বড় হয়েছেন তিনি। ৩১ বছর বয়সী আদনান ইসলাম ধর্মের প্রচুর বই পড়তেন এবং গবেষণা করতেন। দর্শনে স্নাতকোত্তর করা আদনান অল্পদিনেই হয়ে ওঠেন একজন ভালো ইসলামী বক্তা। তিনি উগ্রবাদকে সমর্থন করতেন না বলেও দাবি করেছেন স্বজনরা। তিনি ধর্মীয় বক্তা হিসেবে পরিচিত। তার ফেসবুক পেজের অনুসারীর সংখ্যা ৫২ হাজার।

সাবিকুন্নাহার বলেন, আমার স্বামী যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাকে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করা হোক। সে নিখোঁজ কেন? আমি শুধু তার সন্ধান চাই। তাকে যদি আমার কাছে এনে দিতে না পারেন, তাহলে আমাকে তার কাছে নিয়ে যান। আমি তার স্ত্রী। আমি জানি না আমার স্বামী কোথায়। আমি আপনাদের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছি, আপনারা আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। এর বেশি কিছু চাই না। আমি তাকে অনেক ভালোবাসি।
নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, আমার স্বামী আবু ত্ব-হা রংপুরে সপ্তাহ খানেক থাকেন। এরপর রংপুর থেকে রওনা দিয়েছিলেন বগুড়ার উদ্দেশে। সেখানে তার একটা প্রোগ্রাম ছিল। কোনো কারণে সেই প্রোগ্রাম না হলে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। পথে মোবাইল ফোনে তিনি (ত্ব-হা) আমাকে জানিয়েছিলেন, দুইটি বাইক তাদের বহন করা গাড়িটি অনুসরণ করছিল। শেষ পর্যন্ত আমাকে তিনি তার গুগল ম্যাপ শেয়ার করেছিলেন, সেখানে আমি জানতে পেরেছি মিরপুরে আমার বাসা থেকে তিনি আর ১৭ মিনিটের দূরত্বে আছেন। তখন সময় রাত ২টা ৩৭ মিনিটের কাছাকাছি। তিনি বলেন, তিনি নিরীহ মানুষ, ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তিনি কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন। ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পথে তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। আমি তাকে ফোন দিলে তিনি আমাকে দু’টি মোটরসাইকেল তাদের অনুসরণ করছে বলে জানান। দোয়া করো যেন ভালোভাবে বাসায় ফিরতে পারি। এরপর তিনিই আবার ফোন করে জানান বাইকগুলো চলে গেছে।
সংবাদ সম্মলনে সাবিকুন্নাহার বলেন, খুতবা ও বক্তব্যে তিনি জিও পলিটিক্স নিয়ে কথা বলতেন। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে কথা বলতেন। কাউকে সন্দেহ হয় কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে এখন অনেক কিছুই সন্দেহ হয়। আমার স্থানে আপনারা থাকলে, আপনাদেরও এমনটি মনে হতো। ঘটনার দিন দুপুর ২টার দিকে আমি তাকে ফোন করে রাতে বাসায় ফিরে কি খাবা? কি রান্না করবো? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি রেগে যান আমার ওপর। রেগে গিয়ে ত্ব-হা বলেন, আমাদের প্রাইভেটকারের পেছনে দু’টি বাইক ফলো করছে। আমার জন্য দোয়া করো, আমি যেন ঠিকভাবে বাসায় পৌঁছাতে পারি। এর কিছুক্ষণ পরে তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে বলেন বাইক দু’টি আর দেখা যাচ্ছে না। তুমি রান্না করো, আমরা চারজন বাসায় এসে ভাত খাবো।
সাবিকুন্নাহার বলেন, তার সঙ্গে যখনই কথা হয় তখনই তিনি লোকেশনসহ আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে স্ক্রিনশট পাঠান। ওইদিনও একাধিকবার আমাকে লোকেশন পাঠিয়েছেন। রাত ২টার দিকে সর্বশেষ আমি তাকে ফোন করি। কিন্তু তিনি ঘুমানোর কারণে আমার ফোন রিসিভ করতে পারেননি। ঘুম ভাঙার পরে রাত ২টা ৩৭ মিনিটে একটা ম্যাপ শেয়ার করেন। তখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। এরপর তার মেসেজ দেখে ঘুম থেকে উঠে খাবারের ব্যবস্থা করতে যাই। তার ম্যাপে দেখাচ্ছিল বাসায় পৌঁছাতে ১৮ মিনিট লাগবে। এরপর অপেক্ষা করতে করতে রাত ৩টার দিকে তার নম্বরে ফোন করি। কিন্তু তখন থেকেই তার মোবাইল বন্ধ পাই। এরপর প্রাইভেটকারচালক আমিরের নম্বরে ফোন করি। তার মোবাইলও বন্ধ পাই। তখন আমার সন্দেহ হয়। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে ভোর ৫টা বেজে যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে ত্ব-হার স্ত্রী বলেন, বগুড়ায় যে প্রোগ্রাম হওয়ার কথা ছিল সেটি হয়নি। তিনি রাস্তায় থাকার কারণে বিস্তারিত কথা বলার সুযোগ ছিল না। ভেবেছিলাম বাসায় আসার পর তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করবো। আমার ওপর রেগে যাওয়ার কারণে জিজ্ঞাসা করিনি। শুধু এতটুকুই জানি বগুড়ায় তার প্রোগ্রামটি হয়নি। এর আগে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এর আগে কখনো এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি কিংবা কখনো বলেনওনি। তবে তিনি মজসিদে খুতবা বা লেকচারের কারণে মাঝে মঝে কিছু ঝামেলার সম্মুখীন হতেন বলে আমাকে বলতেন। এ বিষয়গুলো তিনি তার লেকচারেও তুলে ধরেছেন। বগুড়ার প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আয়োজকদের কোনো নম্বর আমার কাছে নেই। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি।
কারো প্রতি সন্দেহ করছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারো প্রতি কোনো ধরনের অভিযোগ নেই। অনেক সময় অনেকে তার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতেন, অনেক রকমের কথা বলতেন। এজন্য কোনো প্রেসার এলো কি-না তা বলতে পারছি না। আবার কখনো মনে হয় তিনি জিও পলিটিক্যালের কথা বলতেন, পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে আলোচনা করতেন। আন্তর্জাতিক কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাজ কি-না তাও বুঝতে পারছি না।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনির বিষয় নিয়ে ত্ব-হার আলোচনার বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা সবাই মুসলিম। আর মুসলিম বলতেই সবাই আল-আকসা মসজিদকে ভালোবাসি। আল-আকসার ব্যাপারে যাদেরই রক্তচক্ষু থাকবে তাদের কারণে আমাদের দিল থেকে একটা যন্ত্রণা থাকবেই। পড়াশোনার বিষয়ে ত্ব-হার স্ত্রী বলেন, তিনি ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছেন এবং সালাফি মাদ্রাসা থেকে আরবিতে অনেক শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তিনি সংকীর্ণ মনের ছিলেন না। হকটা সব জায়গা থেকে গ্রহণ করতেন এবং প্রচুর পড়াশোনা করতেন। বিশেষ করে ত্বকী উসমানীর বইগুলো বেশি পড়তেন। এ ছাড়াও বিদেশি লেখকদের বইও তিনি পড়তেন। তার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল জেনারেল।
ত্ব-হার পরিবারকে আইনি সহায়তা দেয়া ব্যারিস্টার এম. সারোয়ার হোসাইন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, একটি গাড়ি ও চার জন মানুষকে একসঙ্গে এভাবে গায়েব করে দেয়া কোনো প্রাইভেট সংঘের কাজ নয়। এই ঘটনায় রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেয় তাহলে এটা উদ্ধার করা সম্ভব। আমাদের পুলিশ খুবই এফিশিয়েন্ট, তারা বিদ্যুৎ গতিতে ব্যবস্থা নিতে পারে। যেটা পরীমনির ব্যাপারে নিয়েছে। পরীমনি নিজেও স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। এ ঘটনায় যদি রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন মহলে থেকে নির্দেশনা যায়, তবে এটি মাত্র ঘণ্টার ব্যাপার বলে আমি মনে করি। এর আগে সাংবাদিকদের সোচ্চার থাকার কারণে নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আবু ত্ব-হা’র সন্ধানে মানববন্ধন করে ‘আমরা আবু ত্ব-হা’র ভাই ব্যানারে। সেখানে সাধারণ ছাত্ররা বলেন, এটা কোনো দলের পক্ষ থেকে না। আমরা সাধারণ মুসলিম শিক্ষার্থীরা এখানে একত্র হয়েছি, আমাদের ভাই আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান প্রায় ৬ দিন ধরে নিখোঁজ। আমরা তার সন্ধান চাই।
এছাড়া মঙ্গলবার সাবেকুন্নাহার স্বামীকে ফিরে পেতে পুলিশ মহাপরিদর্শক ও র‌্যাব’র মহাপরিচালক বরাবরও দু’টি চিঠি দেন। গত সোমবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাউথ এশিয়ার ফেসবুক পেজে বলা হয়, নিখোঁজ চারজনের অবস্থান জানতে কর্তৃপক্ষের উচিত তাৎক্ষণিক সুষ্ঠু তদন্ত পরিচালনা করা। আর তারা যদি রাষ্ট্রের হেফাজতে থেকে থাকে তবে এখনই তাদের মুক্তি দিতে হবে।