থামছে না টাকার অবমূল্যায়ন

ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কমানোর পর থেকে প্রতিদিনই কমছে টাকার মান, বাড়ছে ডলারের দাম। এতে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা সীমিতভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমদানিকারকরা।

সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভোক্তারা। টাকার মান কমে যাওয়ায় ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। বাড়ছে পণ্যের দাম। সব মিলে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। এটা দিন দিন বেড়েই চলেছে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আপাতত নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না কবে নাগাদ টাকার অবমূল্যায়নে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। গত ছয় মাসে ১২ দফায় টাকার মান কমানো হয়েছে। এক বছরে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা। অর্থাৎ ডলারের দাম বেড়েছে ৮ টাকা।

সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ডলারের দাম আরও বেড়েছে। গড়ে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ১ টাকা। অর্থাৎ ওই হারে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে মঙ্গলবার ব্যাংকগুলোতে আমদানির জন্য প্রতি ডলার গড়ে বিক্রি হয়েছে ৯৩ টাকা করে। আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেন হয়েছে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। আগের দিন ডলার বিক্রি হয় ৯২ টাকা করে। ডলারের একক দর গত বৃহস্পতিবার থেকে তুলে নেওয়া হয়।

এর আগে গত ২৯ মে থেকে ডলারের একক দর কার্যকর করা হয়। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ একেবারেই কম থাকায় একক দর চার দিনের বেশি ধরে রাখতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ডলারের দামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে নেয়। এতে ওই দিনই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৩৫ পয়সা। গত রোববার কমেছে ৪০ থেকে ৬০ পয়সা।

সোমবার কমেছে ২ টাকা ১০ পয়সা। মঙ্গলবার কমল ১ টাকা। অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের পর থেকে প্রতিদিনই কমেছে। এ সপ্তাহে ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে। কমতে পারে টাকার মান।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা। অর্থাৎ ডলারের দাম ৮ টাকা বেড়েছে। গত বছরের ১ জুলাই প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা করে।

মঙ্গলবার বিক্রি হয়েছে ৯৩ টাকা করে। ওই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। অথচ বছরের শুরুতে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১ থেকে ২ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। গত অর্থবছরে টাকার মান কমেছিল দেড় শতাংশ। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল ছিল। গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। গত মার্চ থেকে ডলার সংকট শুরু হয়। এপ্রিলে এসে সংকট বাড়ে। মে মাসে প্রকট আকার ধারণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোকে ডলার দেওয়া হবে। রিজার্ভ রাখাই হয় জরুরি প্রয়োজন মেটাতে। এখন জরুরি প্রয়োজন হয়েছে তাই ডলার দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করেছে। আশা করা যায় রেমিট্যান্স বাড়লে ধীরে ধীরে এ সংকট কেটে যাবে।

আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম দীর্ঘদিন ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা ছিল। গত বছরের জুলাই থেকে ৫ পয়সা করে দাম বাড়তে থাকে। বছর শেষে তা ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়ায়। গত জানুয়ারির শুরুতে ডলারের ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা হয়।

২৩ মার্চ আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম আরও ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় ওঠে। ২৭ এপ্রিল এর দাম ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায় দাঁড়ায়। ৯ মে ডলারের দাম ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সায় হয়। গত ১৬ মে আরও ৮০ পয়সা বেড়ে প্রতি ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২৩ মে এর দাম ৪০ পয়সা বেড়ে ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা হয়। এর পর ১ টাকা ১০ পয়সা দাম বেড়ে ৮৯ টাকা হয়।

আন্তঃব্যাংকে বৃদ্ধির সঙ্গে বাজারেও দাম বাড়তে থাকে। গত ৪ জানুয়ারি আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করেছে ৮৬ টাকা করে। ১ ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা হয়। ২৩ মার্চ তা আরও বেড়ে ৮৬ টাকা ৪০ পয়সায় দাঁড়ায়। এভাবে ২৭ এপ্রিল ৮৬ টাকা ৮০ পয়সা, ৯ মে ৮৭ টাকা,৯০ পয়সা হয়। এর পর ১ টাকা ১০ পয়সা দাম বেড়ে ৮৯ টাকা হয়।

আন্তঃব্যাংকে বৃদ্ধির সঙ্গে বাজারেও দাম বাড়তে থাকে। গত ৪ জানুয়ারি আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করেছে ৮৬ টাকা করে। ১ ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা হয়। ২৩ মার্চ তা আরও বেড়ে ৮৬ টাকা ৪০ পয়সায় দাঁড়ায়। এভাবে ২৭ এপ্রিল ৮৬ টাকা ৮০ পয়সা, ৯ মে ৮৭ টাকা, ১৬ মে ৮৭ টাকা ৮০ পয়সা, ২৩ মে ৮৮ টাকা ১০ পয়সা, ২৬ মে ৮৯ টাকা, ২ জুন ৯১ টাকা ৩৫ পয়সা, ৫ জুন ৯১ টাকা ৫০ পয়সা, ৬ জুন ৯২ টাকা, ৭ জুন ৯৩ টাকা দরে ডলার বিক্রি হয়।

সূত্র জানায়, বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে ৪৪ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৪ শতাংশ ও রেমিট্যান্স কমেছে ১৬ শতাংশ।

বর্তমানে প্রতি মাসে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, ভ্রমণ ও চিকিৎসা খাত মিলিয়ে গড়ে ৯৫০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি ডলারের প্রয়োজন হয়। এর বিপরীতে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ মিলিয়ে ৭৪০ থেকে ৭৫০ কোটি ডলার পাওয়া যায়। এতে প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ২১০ কোটি থেকে ২৫০ কোটি ডলার। মাসে গড় ঘাটতি দাঁড়ায় ২৩০ কোটি ডলার।

ওই ঘাটতি মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হচ্ছে। এতে রিজার্ভের স্থিতিও কমছে। গত জুনে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এখন তা কমে ৪ হাজার ২২০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। রিজার্ভ থেকে খুব বেশি দিন ডলারের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে পাইপলাইনে যেসব বৈদেশিক সহায়তা আটকে রয়েছে সেগুলোও ছাড় করানোর প্রচেষ্টা চলছে।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি আয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মে মাসে রপ্তানি আয় কম এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগাম পূর্বাভাস দিয়েছে আগামী জুলাই থেকে রপ্তানির আদেশ কমে যেতে পারে।

ফলে রপ্তানির কাঁচামাল আমদানিও কমবে। এর প্রভাব পড়বে আগামী অক্টোবর থেকে। রপ্তানি আয় কমে গেলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। কেননা এখন রপ্তানি আয় বাড়ছে, রেমিট্যান্স কমছে, তারপরও ডলার বাজার সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দুটোই কমতে থাকলে বাজারে কী অস্থিরতা দেখা দিতে পারে তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত।