সুনামগঞ্জে বাড়ছে ধর্ষণ, আট মাসে ৫১ মামলা

সম্প্রতি সুনামগঞ্জের হালুয়ারগাঁও গ্রামে ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে আব্দুল কাহার নামের এক ৬০ বছরের বৃদ্ধকে গ্রেপ্তার করে সদর থানা পুলিশ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১২ সেপ্টেম্বর পরিবারে অগোচরে শিশুকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে ওই বৃদ্ধ। স্থানীয়দের সহযোগিতায় শিশুটিকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় শিশুটির পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দায়ের করলে আব্দুল কাহারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গেল ১৫ সেপ্টেম্বর জেলার শাল্লা উপজেলায় সালিসের মাধ্যমে ধর্ষণের বিচার করে দেওয়ার কথা বলে ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে নিয়ে ফের পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ইউপি চেয়ারম্যান ও এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে।

এই ঘটনায় উপজেলার বাহারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু ও ইউপি সদস্য দেবব্রত দাশকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেছে নির্যাতিতা কিশোরীর পরিবার। এমন ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যের বিচারের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি করছেন এলাকাবাসী।

ধর্ষণের এসব ন্যক্কারজনক ঘটনায় সর্বত্রই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসন না মানাসহ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় এমন ঘটনার প্রবণতা বাড়ছে বলে দাবি সচেতন মহলের। নারী প্রতি সংহিংসতা, নারী ও শিশু ধর্ষণ বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং দোষীদের সর্বোচ্চ বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলেছে সচেতন নাগরিক সমাজ।

এদিকে, চলতি বছরের ঘটে যাওয়ায় ধর্ষণের পরিসংখ্যানে সচেতন মহলের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। প্রেম ও বিয়ের প্রলোভনে পড়ে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। বেশির ভাগ এসব ঘটনার শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীরা। আর পরকিয়ার প্রেমে পড়ে বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন কতিপয় গৃহবধূ। কোথাও কোথাও বিচার কিংবা সালিসের নামেও ঘটছে নারী প্রতি সংহিসতা। তাছাড়া সামাজিক অবক্ষয় ও মাদকাসক্ত বিপদগ্রস্ত লোকদের বেপরোয়া কার্যকলাপে বাড়ছে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা।

এসব ঘটনার বেশির ভাগই আদালত পর্যন্ত গড়ালেও ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী হলে তাদের ক্ষমতার প্রভাবে স্থানীয় সালিসে অনেক ঘটনার সুবিচার চাপা পড়ে যায়। ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন না হওয়ায় অপরাধীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় বলে দাবি অনেক বিশ্লেষকদের।

সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে জেলার ১২ থানায় মামলা হয়েছে ৫১টি। শিশু থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পুড়ুয়া কিশোরী ও গৃহবধূ ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে এসব মামলার এজহারে। এসব ধর্ষণ মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। ধর্ষণের এসব মামলা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।

জানা যায়, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে সদর থানায় গেল আট মাসে মামলা হয়েছে ১৫টি। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৪ আসামি। ছাতক থানায় মামলা হয়েছে ৯টি। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৯ জন। জগন্নাথপুরে ৫টি ধর্ষণের মামলা গ্রেপ্তার হয়েছে ৪ জন। দোয়ারাবাজারে মামলা হয়েছে ৫টি এবং গ্রেপ্তার ৬ জন। তাহিরপুরে মাত্র ১টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এই মামলায় ১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিশ্বম্ভরপুরে ২টি মামলায় ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দিরাই থানায় ধর্ষণ মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জামালগঞ্জ থানায় ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৬টি। এসব মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে জামালগঞ্জ থানা পুলিশ। ধর্মপাশায় একটি ধর্ষণ মামলায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মধ্যনগর থানায় মামলা হয়েছে ৩টি। গেল ৮ মাসে শাল্লা ও শান্তিগঞ্জ থানায় ধর্ষণের অভিযোগে কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জেলার ধর্ষণ মামলার এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক বলে জানিয়ে সুজনের সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক আবু সাঈদ বলেন, দিন দিন নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনার হার বাড়ছে। যা আমাদের নারী নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। জেলার আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখা ও নারী প্রতি সহিংসতা বন্ধে আইনি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও সুধীজনদের এগিয়ে আসতে হবে। সামজিক অবক্ষয় রোধ না করলে ভবিষ্যতে এই হার বাড়তেই থাকবে বলে ধারণা এই বিশ্লেষকের।

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ বলেন, সামাজিক অবক্ষকের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেশি হয়। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি অবাদ ব্যবহার সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে যা এক পর্যায়ে প্রেমসহ অন্য দিকে মোড় নেয়। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। আমাদের ১২টি থানাকে ৯৮ বিটে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণ ও নারী সহিংসতা প্রতিরোধে বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে আমাদের পুলিশ প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে সচেতনা সৃষ্টি করছে। তাছাড়া ধর্ষণের ঘটনা ঘটনার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তারের বাধ্যবাধকতা করে থাকি।

গুরুত্ব নিয়ে দ্রুত সময়ে পুলিশ তদন্ত নিষ্পত্তি করে থাকে বলে জানান তিনি।