৫৭০ সালের এই দিনে যা ঘটেছিল

‘রবিউল আউয়াল’ ইসলামি বর্ষপঞ্জির তৃতীয় মাস। এটি অন্যান্য মাস থেকে বেশি গুরুত্ব বহন করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই মাসেই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং এই মাসেই তিনি ইন্তেকাল করেন। নবিজি (সা.) জন্মগ্রহণের কারণে যেমন এই মাসের ফজিলত বেড়েছে। ৫৭০ সালে মক্কায় বিখ্যাত কোরাইশ বংশে জন্ম নেন বিশ্ব মানবতার দূত, রাহমাতুল্লিল আলআমিন হজরত মোহাম্মাদ (সা.)। দিনটি ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার। তবে এদিন নবি (সা.) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন কিনা তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ও আলেম মনে করেন ১২ই রবিউল আউয়াল তাঁর জন্মদিন।

অন্যদিনে নবি (সা.) এর বংশধর আহলে বাইতের বর্ণনা অনুযায়ী রাসুল (সা.) এর জন্মদিন ১৭ই রবিউল আউয়াল। এজন্য বিশ্বের অনেক মুসলমান ১২ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান পালন করেন।

কায়স ইবনে মাখরামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুজনেই ‘হাতীর বছরে’ জন্মগ্রহণ করেছি। উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু কুবাস ইবন আশইয়ামকে প্রশ্ন করেন, আপনি বড় না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড়? তিনি উত্তরে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার থেকে বড়, আর আমি তাঁর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘হাতীর বছরে’ জন্মগ্রহণ করেন।’ হাতীর বছর অর্থাৎ যে বৎসর আবরাহা হাতী নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য মক্কা আক্রমণ করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এ বছর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ ছিল।

অনেক ইতিহাসবিদের মতে ইয়ামেনের গভর্নর আবরাহার হস্তী বাহিনী যেদিন ধ্বংস হয় যেদিন জন্ম নেন রাহমাতুল্লিল আলআমিন বিশ্বনবি মুহাম্মদ (সা.)। আর ঐদিনটিই ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল। এই দিনে পবিত্র কাবা ঘর আক্রমণ করতে আসা ইয়েমেনের আবিসিনিয় গভর্নর আবরাহা তার হস্তী বাহিনীসহ ধ্বংস হয়। আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু আবাবিল পাখির মুখে থাকা ক্ষুদ্র কঙ্কর আবরাহার হস্তী বাহিনীর ওপর বর্ষিত হলে তারা ঘাসের সঙ্গে বিলিন হয়ে পড়ে। বলা হয়, আবরাহা চেয়েছিল ইয়েমেনে একটি বিকল্প কাবা-ঘর বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে যাতে এর মাধ্যমে ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার করা যায়। কিন্তু তার আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি।

ইতিহাসে এসেছে, আবরাহার সেনারা কুরাইশ গোত্রের প্রধান ও বিশ্বনবি (সা.) এর দাদা হজরত আবদুল মুত্তালিবের উটগুলো নিয়ে যাওয়ায় তিনি আবরাহার সঙ্গে দেখা করে তার উটগুলো ফেরত চান। আবরাহা ভেবেছিল আবদুল মুত্তালিব এসেছেন কাবা ঘরে হামলা না চালানোর জন্য তার কাছে কাকতি-মিনতি করতে। তাই বিস্মিত আবরাহা বলে, কাবা ঘর রক্ষা নিয়ে তোমার চিন্তা নেই? হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর পুত্র ইসমাইল (আ.) এর বংশধর ও একত্ববাদে বিশ্বাসী আবদুল মুত্তালিব বলেন, এই ঘরের যিনি মালিক (আল্লাহ) তিনিই তার ঘর রক্ষা করবেন, উটের মালিক হিসেবে আমি কেবল আমার উটগুলো ফেরত চাই।

হাদিস শরীফে এসেছে, আবু কাতাদা আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘সোমবারের রোজা সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, আর এই দিনেই আমাকে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে (কিংবা তিনি বলেছেন) এই দিনেই আমার ওপর (প্রথম) ওহী নাজিল করা হয়েছ’ (মুসলিম: ১১৬২, আবু দাউদ: ২৪২৬)।

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখেই বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর নির্দেশে ইয়াসরিব বা মদীনা শহরের কাছে কুবা গ্রামে নির্মিত হয় ইসলামের প্রথম মসজিদ। বিশ্বনবি (সা.) এর হিজরতের ঘটনা ঘটেছিল একই বছর পহেলা রবিউল আউয়াল তারিখে। মদিনায় প্রবেশের আগে বিশ্বনবি (সা.) এখানে কয়েক দিন অবস্থান করেছিলেন যাতে তাঁর চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবু তালিব মক্কা থেকে এখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। হিজরতে রওনা হওয়ার রাতে কাফেরদের ধোঁকা দিতে হজরত আলী চাদর মুড়ি দিয়ে মহানবি (সা.) এর বিছায় শুয়ে ছিলেন।

এ ছাড়াও রাসুল (সা.) তাঁর কাছে মক্কাবাসীদের গচ্ছিত আমানতগুলো ফেরত দেয়ার জন্য আলী কে দায়িত্ব দেন। আলী সেইসব দায়িত্ব পালন করায় মদীনার দিকে তিন দিন পর রওনা হন। অবশেষে তিনদিন পর হজরত আলী কুবা গ্রামে এসে পৌঁছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নিজের মা তথা রাসূল (সা.) এর চাচী ফাতিমা বিনতে আসাদ এবং নিজের ভবিষ্যত স্ত্রী ও বেহেশতি নারীদের প্রধান নবি-কন্যা হজরত ফাতিমা (রা.) সহ বনি হাশিম গোত্রের মহিলারা।

এরপর আল্লাহর রাসুলের (সা.) ইমামতিতে কুবার এই মসজিদেই জুমা’র নামাজ আদায় করা হয়। যা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুমা’র নামাজ। ইসলামে কুবা মসজিদে নামাজ আদায় করার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

নবিজি (সা.)-এর জন্মের ঘটনার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো তার জীবনাদর্শের অনুসরণ। যেমন- নবিজির জন্ম, শৈশব, নবি হিসেবে প্রেরণ, দাওয়াত, জিহাদ, ইবাদত, আখলাক-চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা, তাকওয়া-তাহারত, দয়া-ভালোবাসা, রাগ-ক্রোধ, হাসি, ওঠা-বসা, হাঁটা, ঘুম-জাগরণসহ যাবতীয় চালচলন ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহর সামনে উপস্থাপন করা। এগুলো সামনে রেখে আলোচনাসভার অয়োজন করা, অবশ্যই ভালো এবং প্রশংসনীয় কাজ। রবিউল আউয়াল মাসে ইসলাম সমর্থন করে না এমন কাজে মেতে না উঠে এগুলো করা যেতে পারে।

এ ছাড়াও প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের তিনটি রোজা রাখার কথা এসেছে হাদিসে। এর প্রতি যত্নশীল হওয়া যেতে পারে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আ’মর ইবনে আ’স (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়াম পালন, সারা বছর ধরে সিয়াম পালনের সমান’ (বোখারি: ১১৫৯, ১৯৭৫)।

আর প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার অভ্যাস করা। রাসুল (সা.) এ দুই দিন বিশেষ রোজা রাখতেন। এ বিষয়ে নবিজি (সা.) বলেন, ‘বৃহস্পতি ও সোমবার আল্লাহ তায়ালার সামনে বান্দার আমল উপস্থাপন করা হয়, তাই আমি চাই- আমার আমল পেশ করার সময় আমি যেন রোজা অবস্থায় থাকি’ (সুনানে নাসায়ী: ২৩৫৮)।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকাল দিবস কামনা করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আল-আহজাব: ২১)।