ছাদবাগান গড়ে তুলেছেন শৌখিন চাষী মোঃ সেলিম আহমেদ

‘বিটিভি ও চ্যানেল আই-তে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষিবিদ শাঁইখ সিরাজের ‘মাটি ও মানুষ’ শিরোনামের কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো মাঝে-মধ্যে দেখতাম। ওখান থেকেই মূলতঃ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। আর এই সুবাদে সেই ১০/১১ বছর আগে শখের বশে আমার বসতবাড়ির ছাদে ৪/৫টি গাছ লাগিয়ে শুরু করেছিলাম ছাদবাগান। কয়েকদিনের পরিচর্যায় লাগানো গাছগুলোর প্রতি মায়া লেগে যায়। আর পিছু হঠতে পারিনি। ধীরে ধীরে ছাদবাগানের প্রতি এতো আকৃষ্ট হয়েছি যে, এখন আমি পুরোদস্তর একজন ছাদবাগান চাষী। ফুল-ফল আর সবজিতে সাজিয়েছি আমার ছাদবাগানটি। অদূর ভবিষ্যতে আমি এটিকে আরো পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে চাই।’ কথাগুলো হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলছিলেন ছাদবাগান চাষী মোহাম্মদ সেলিম আহমেদ। তিনি নগরির ২৫নং ওয়াডের লাউয়াই উম্মরকবুলস্থ আব্দুল গণি ভিলার বাসিন্দা। একান্ত নিজের প্রচেষ্টায় বসতবাড়ির ১ হাজার ৮শ’ বর্গফুটের ছাদে খুব যতœ করে গড়ে তুলেছেন একটি সুদৃশ্য ছাদবাগান। সত্যিই সুন্দর এবং দেখার মতো। ছাদবাগানে আছে অনেক কিছু। ফুল-ফল আর নানা জাতের সবজি মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৬০/৬৫ জাতের উদ্ভিদ। সঙ্গে আছে একঝাঁক কবুতরও। যা দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মনোরম পরিবেশে, শ্যামলে-সবুজে আচ্ছাদিত ছাদবাগানের একপাশে রাখা চেয়ারে বসে কথা হলো শৌখিন ছাদবাগান চাষী মোহাম্মদ সেলিম আহমেদের সাথে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় বলে গেলেন তাঁর সুন্দর ছাদবাগান গড়ে তোলার কথা। বললেন, ১৯৯১ সালে (তখন তিনি ংংপ পরীক্ষার্থী) আব্বার মৃত্যুর পর থেকে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসায় (যা ৬ প্রজন্ম থেকে চলে আসছে) মনযোগী হলেও আমার মন পড়ে থাকতো সবুজ বৃক্ষরাজির পাশে সময় কাটানোর জন্য। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের পর দিনের কিছুটা সময় ফ্রি থাকার ব্যবস্থা করে নেই। তখন আমাদের বাড়ির খোলা জায়গাতে বিভিন্ন রকম বাগান করতাম আমার আম্মাসহ আমরা ভাই-বোনেরা মিলে। তার অনেক দিন পরে একদিন মনস্থির করলাম। আমাদের বসতবাড়ির তৃতীয়তলায় বেশ বড় একটা ছাদ রয়েছে,ওটাকে কি কাজে লাগানো যায় না? এমন চিন্তা থেকেই পরীক্ষামুলক কয়েকটি গাছ লাগিয়ে ছাদবাগান শুরু করলাম। শুরুতে কষ্ট করবো দেখে আমার আম্মা নূরজাহান বেগম আমাকে উৎসাহ দেখাননি। আমার বাবা আব্দুল মতিন বেঁচে নেই। ১৯৯১ সালে মারা গেছেন। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে মা আমাকে চোখে চোখে রাখেন। তাই আমার কষ্ট হবে, মা এটা সহ্য করতে পারেন না। তবে কয়েকদিন পর যখন ছাদে উঠে দেখেন আমার রোপনকৃত গাছগুলো খুব সুন্দরভাবে নতুন পাতা দিয়ে বেড়ে উঠার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে, তখন তিনিও আকৃষ্ট হয়ে আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকেন। আর শুরু থেকেই তো আমার স্ত্রী হেলন আক্তার ছিলেন পরম সহযাত্রী। পাশাপাশি যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবার ছোট ভাই খালেদ আহমেদ আমাকে উৎসাহ দিতে থাকে।’ 

সেলিম আহমেদ বলেন ‘পরিবারের অনুপ্রেরণা পেয়ে আমারও উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। জোর কদমে শুরু করি ছাদবাগান গড়ার কাজ। একে একে রোপন করি নানাজাতের ফলবৃক্ষ। লাগিয়েছি অনেক ফুলগাছও। আর নানা রকমের সবজি তো নিয়মিতই লাগানো থাকে। এ পর্যন্ত আমার ছাদবাগানে লাগানো আছে বারোমাসি কয়েক জাতের আম, থাইল্যান্ডি জাম্বুরা, বরিশালী আমড়া, মিষ্টি ফল সফেদা, ডালিম, মিষ্টি কামরাঙা, ড্রাগন ফল, উন্নতমানের কয়েক জাতের পেয়ারা, কমলালেবু, মাল্টা, আঙুর, সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় ঝাড়া লেবু, কাগজি লেবু, কট লেবু, আদা লেবু, কাটা লেবু, তেজপাতা, আছে উন্নতমানের মিষ্টি আখও। ফুলের মধ্যে আছে বহুরঙা গোলাপ, সূর্য্যমুখী, বাগান বিলাস, বিভিন্ন ধরণের ক্যাকটাস। সবজির মধ্যে রয়েছে লাউ, টমেটো, সীম, বরবটি, বিরাট লম্বা সাইজের চাপাই-কোপাই জাতের কাঁচামরিচ, বোম্বাই মরিচ (যেটাকে সিলেট অঞ্চলে বলে নাগামরিচ), বেগুন, করলা ইত্যাদি। আর এসবের সাথে পালন করেছি উন্নতমানের কয়েক জাতের কবুতর। সংখ্যায় প্রায় শতাধিক হবে।’

তিনি বলেন, যে মনোভাব নিয়ে ছাদবাগান শুরু করেছিলাম, এখন সেটি আরো দৃঢ় হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন-ই পাড়া-মহল্লার কেউ না কেউ আমার ছাদবাগান দেখতে আসেন। বাইরে থেকেও বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনও এসে দেখে যান। তখন খুব ভাল লাগে। কেউ আসলে চেষ্টা করি বাগানে উৎপাদিত কোন না কোন ফল বা সবজি হাতে তুলে দিতে। হউক না তা অল্প। তাও তো নিজের বাগানে উৎপাদিত। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এতে আমি খুব আনন্দ পাই। আমার ছাদবাগানে উৎপাদিত কোন কিছু কারো হাতে তুলে দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হয়।’

ভবিষ্যতে কী এগুলো বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে আগ্রহী? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না, আমার ছাদবাগানে উৎপাদিত ফল-ফলারি বা কোন কিছু বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিক্রি করবো না। শখের বশে গড়ে তুলেছি। এলাকাবাসীর মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে তৃপ্তি পাই। আমার ছাদবাগানে উৎপাদিত ফল-ফলারি বা সবজি আমি অনেককে গিফট্ হিসেবে দেই। এর কারণ, তাদের মধ্যে উৎসাহ তৈরী করা। যাতে আরো অনেকে এভাবে ছাদবাগান করে বাজারের বিভিন্ন কেমিক্যালযুক্ত পণ্য না কিনে নিজের বাগান থেকে উৎপাদিত ঠাটকা ফল-ফলাদি বা সবজি খেতে পারেন।

প্রতিবেদক প্রশ্ন করেছিলেন, এতো বড় একটা ছাদবাগান করতে নিশ্চয়ই আপনার অনেক পরিশ্রম হয়েছে? শুনেছি, সম্প্রতি আপনার শরীরে একটি বড় অস্ত্রোপচার হয়েছে,আগে থেকেও অসুস্থ। এ অবস্থায় ছাদবাগানের এতো বিপুল সরঞ্জাম কিভাবে ৩ তলার ছাদে তুলে নিলেন?

উত্তরে সেলিম আহমেদ বলেন, আগেই তো বলেছি এক্ষেত্রে আমার স্ত্রী হেলন আক্তার শুরু থেকেই আমাকে সহযোগিতা করতেন। আর দেশে আরেক ছোট ভাই মাছুম আহমেদ সাধ্যমত সহযোগিতা করেছে। কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সহায়তা করে ভার্সিটি ও কলেজ পড়–য়া আমার দুই মেয়ে, ক্লাস টেনে পড়ুয়া ছোট মেয়ে আর আমার ছোট ভাই মাছুমের মেয়েরা। আমার ছেলেটি এখনও অনেক ছোট। স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। তারপরও সে আমাকে সাধ্যমত সহযোগিতা করে। এছাড়া ভারী কাজের জন্য মাঝে-মধ্যে দৈনিক মজুরীতে শ্রমিক নিতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি যখন শরীরে অপারেশন হয়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসি। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবরা দেখতে এসেছেন। সম্ভব হলে ছাদবাগানে উঠে তাদের নিয়ে বসে গল্প করে সময় কাটিয়েছি। তখন শরীরের কষ্টটা তেমন অনুভব করিনি।’

উঠে আসার এ প্রতিবেদককেও নিজের ছাদবাগানের উৎপাদিত টমেটো, কট লেবু, লম্বা সাইজের কাঁচামরিচ, নাগামরিচ ইত্যাদি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমার জন্য দোয়া করবেন। যেন আমি নিয়মিত নিজের হাতে চাষ করে এভাবে এলাকাবাসীর মাঝে বিলিয়ে দিতে পারি। আর এটিই আমার আনন্দ। ভাল থাকবেন।