ঢাকার সড়কে ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাই

এটিএম বুথে টাকা রিফিল করতে যাওয়ার পথে ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের (ডিবিবিএল) একটি মাইক্রোবাস থেকে ১১ কোটি টাকা ছিনতাই হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সেতু এলাকায় প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানির কর্মকর্তারা মিরপুরের ব্যাংকের অফিস থেকে টাকা নিয়ে সাভারের দিকে যাওয়ার পথে ডাকাতদের কবলে পড়েন। পথিমধ্যে ডাকাত দল কোম্পানিটির বিশেষভাবে ‘মডিফাইড’ মাইক্রোবাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ টাকাগুলো ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় ডাকাতিতে ব্যব হৃত গাড়িটি জব্দ এবং সাত ডাকাতকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া প্রায় নয় কোটি টাকার মতো উদ্ধার হয়েছে বলে দাবি করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তবে তুরাগ থানা বলছে, উদ্ধার হওয়া তিনটি ট্রাংকে টাকা গণনা শেষে মোট ৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা পাওয়া গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রগুলো জানায়, মিরপুর ডিওএইচএস থেকে সিকিউরিটি কোম্পানি মানি প্লান্টের গাড়িতে করে চারটি ট্রাংকে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সাভারের ইপিজেড বুথে নেওয়া হচ্ছিল। পথে উত্তরায় একদল ডাকাত মাইক্রোবাসে এসে ওই গাড়ির গতিরোধ করে। এরপর গাড়িতে থাকা লোকজনকে চড়-থাপ্পড় ও ঘুসি মেরে টাকাভর্তি চারটি ট্রাংক ছিনিয়ে একটি কালো মাইক্রোবাসে উঠে পালিয়ে যায়। ঘটনার পরপরই ডিবি, থানা পুলিশ, পিবিআইসহ পুলিশের কয়েকটি ইউনিট বিভিন্ন সড়কে ব্যাপক তল­াশি শুরু করে। এরপর বিকাল ৫টার দিকে খিলক্ষেত এলাকা থেকে কালো হায়েস মাইক্রোবাসটিসহ টাকার তিনটি ট্রাংক উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, চক্রটি মাইক্রোবাসটি ভাড়া করেছিল।

টাকাগুলো উদ্ধারের পর সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ডিবি জানায়, চারটি ট্রাংকের মধ্যে তারা তিনটি উদ্ধার করেছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ টাকা উদ্ধার হয়েছে। এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলের আশপাশের এলাকা থেকে লুট হওয়া বেশিরভাগ টাকা উদ্ধার করেছি। মোট চার ট্রাংক টাকা লুট হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি ট্রাংক উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ৯ কোটি টাকার মতো উদ্ধার হয়েছে। এখনও অভিযান চলছে।

এদিকে তুরাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শরীফুল ইসলাম জানান, ‘উদ্ধার হওয়া তিনটি ট্রাংকের একটি ছিল ফাঁকা। সেখানে থাকা টাকা গণনা শেষে মোট ৩ কোটি ৮৯ লাখ পাওয়া গেছে।’ উদ্ধারকৃত টাকার পরিমাণ ৩ কোটি ৮৯ লাখই বলে জানিয়েছেন টাকা পরিবহণের দায়িত্বে থাকা মানি প্লান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বদরুল হাসান বলেন, ডাকাতদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। তাদের একজন নিজেকে ডিবি পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে। ডাকাতরা সিকিউরিটি কোম্পানির কর্মীদের চড়-থাপ্পড় ও ঘুসি মেরে সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। টাকা বহন করার সময় নিয়ম অনুযায়ী সিকিউরিটির কোম্পানির কর্মীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা থাকলেও তাদের হাতে তা ছিল না।

ডাচ্?-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, টাকা বহন ও এটিএম বুথে জমার দায়িত্ব নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের। আবার এই টাকা বিমার আওতায় রয়েছে। ফলে এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্লান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-চ-৫১-৬৫৭৯০) বুথে টাকা রাখতে ঢাকা থেকে সাভার ইপিজেড যাচ্ছিল। তুরাগ থানার ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় টাকা বহনকারী কোম্পানির গাড়িটি গেলে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস সেটির গতিরোধ করে। কোনো কারণ ছাড়াই হর্ন বাজানো নিয়ে তারা ঝগড়া শুরু করে। কালো রঙের মাইক্রোবাসে ১০ থেকে ১২ জন ছিল। কয়েকজনের মুখে মাস্কও ছিল। গতিরোধের পর গাড়িটি থেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেরিয়ে আসে। পরিচয় জানতে চাওয়া মাত্র তারা অস্ত্র বের করে সবাইকে জিম্মি করে। কথা বললে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। এ সময় টাকা বহনকারী সবাইকে গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে ছিনতাইকারীরা গাড়িটি থেকে টাকার চারটি ট্রাংক বের করে এবং কালো মাইক্রোবাসে তুলে দ্রুত চলে যায়। এরপর টাকা বহনকারী গাড়ির লোকজন বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানায়। ট্রিপল নাইনে ফোন পেয়ে ডিবি পুলিশ ও থানা পুলিশের দল ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে ছুটে যান ডিএমপির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে তারা বিষয়টি জানেন। ভুক্তভোগীরাও তুরাগ থানায় যান।

প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক সাব্বির আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, সকালে সড়ক ফাঁকা ছিল। লোকজনের আনাগোনাও ছিল কম। এ সময় একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস হঠাৎ আরেকটি মাইক্রোবাসের সামনে এসে দাঁড়ায়। কালো রঙের মাইক্রোবাসের সামনে ‘ডিবি পুলিশ’ লেখা ছিল। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় চা দোকানি সবুজ জানান, ডিবি পুলিশের স্টিকার দেখে টাকা বহনকারী গাড়িটি উদ্বেগ ছাড়াই দাঁড়িয়ে যায়। তারা মনে করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি হয়তো তাদের কিছু জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু এরপর অন্য ঘটনা ঘটে। গাড়ি থেকে নামার পর তারা অশ্লীল ভাষায় চিৎকার করতে থাকে এবং সবাইকে গাড়িতে ঢোকার নির্দেশ দেয়। এরপর টাকার ট্রাংক নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। তিনি আরও জানান, কালো রঙের গাড়িতে করে তারা চলে যাওয়ার পর টাকা বহনকারী গাড়ির লোকজন চিৎকার করতে থাকেন। তাদের চিৎকারে লোকজন এগিয়ে আসে। টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা জানাজানি হয়।

মানি প্লান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালক অজয় কর সাংবাদিকদের জানান, টাকা বহনকারী গাড়িটি সাভার ইপিজেড যাওয়ার জন্য মিরপুর ডিওএইচএস অফিস থেকে বের হয়। দিয়াবাড়ী পার হওয়ার সময় গাড়িটি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। ১০ থেকে ১২ ছিনতাইকারী গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তারা চলে যায়। তিনি আরও জানান, ছিনতাই হওয়া টাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। টাকা বহনের আগে পুলিশকে জানানো হয়েছিল কি না তা তিনি জানাতে পারেননি।

এ বিষয়ে উত্তরা বিভাগের ডিসি মোর্শেদ আলম জানান, কোম্পানির গাড়িটিতে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিল। ১১ নম্বর ব্রিজ হয়ে গাড়িটি সামনের দিকে এগিয়ে গেলে পেছন থেকে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস ডান থেকে বামে যেতে চাপ দিয়ে হর্ন দেয় এবং গাড়িটির গতিরোধ করে। হর্ন দেওয়া নিয়ে তারা প্রথমে কোম্পানির গাড়িটির চালকের সঙ্গে ঝগড়া করে। এরপর মাইক্রোবাসের চালক কোম্পানির সুপারভাইজারকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনে। কোম্পানির গাড়িতে একজন ম্যানেজার ছিলেন। তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে এবং গাড়িটি থেকে টাকার চারটি ট্রাংক নামায় এবং কালো রঙের একটি হায়েস মাইক্রোবাসে তুলে ছিনতাইকারীরা দ্রুত পালিয়ে যায়।

ঘটনাটি পরিকল্পিত কি না জানতে চাইলে ডিসি মোর্শেদ আলম জানান, ডাকাতির এত বড় ঘটনা ঘটার মতো পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা নেওয়া হবে। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে গেলে পুলিশকে জানানো হয়। কিন্তু এত টাকা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের জানানো হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন জানান, টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। টাকা বহন ও এটিএম বুথে জমার দায়িত্ব নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের। এ টাকা বিমার আওতায় রয়েছে।