কেমন ছিল প্রিয় নবীজির (সা.) রমজান

রোজা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মেলবন্ধনের সেতু। রমজান, দেহ-মন পরিচর্যার, আত্মিক শুচিশুদ্ধতা লাভের অন্যতম মাধ্যম। রমজান, মুমিনের জীবনের শ্রেষ্ঠতম আনন্দের ক্ষণ।রমজান মাসকে ঘিরে মুমিনের মনোহৃদয় নতুন সাজে সজ্জিত হতে থাকে ,চোখের তারায় চিরসবুজ জান্নাতের ছবি ফুটে ওঠে। শুদ্ধতার- শুভ্রতার ফুল ফোটে মুমিনের হৃদবাগে।

আকুলপ্রাণে অনেকেই জানতে চায়, আচ্ছা! কেমন ছিলো আমাদের প্রিয় নবীজির রমজান ? কীভাবে কেটেছিলো তার দিনরাত? আমরাও তো চাই প্রিয় নবীজির মতো রমজান কাটাতে, তার আদর্শে আদর্শিত হতে। কেননা তার রেখে যাওয়া আদর্শে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে। 

মুমিন হৃদয়ের এ বাসনা পূরণ করতে আমাদের হৃদয়ের বাদশাহ নবী কারীম (সা.) মহিমান্বিত এ মাসে রবের পরম সান্নিধ্য লাভে নিজেকে সফলভাবে সমর্পণ করার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। 

একজন সফল-স্বার্থক রোজাদার হিসেবে স্বীকৃতি পাবার জন্যে কী কী করতে হবে তা আমল করে দেখিয়েছেন। চলুন, তাহলে আলোচনা করি কীভাবে কেটেছে প্রিয় নবীজির

সাদাসিধে ও সরল জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন আমাদের প্রিয় নবীজি। জীবনে সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর। সীমাহীন প্রাচুর্যের হাতছানি উপেক্ষা করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবন। খাবারের ব্যাপারেও ছিলো এ সারল্যের ছাপ। নবীজির খাবার গ্রহণের এ সারল্য ও অল্পতুষ্টি বজায় থাকতো রমজানের সেহরির সময়ও।

তিনি সাধারণ খাবার দিয়ে সেহরি করতেন। ঘরে যখন যা থাকতো তাই সেহরি হিসেবে গ্রহণ করতেন। 

সেহরির খাবার হিসেবে তার বিশেষ কোনো পছন্দের কথা জানা যায় না। তবে হ্যাঁ, তিনি অন্য সব সময়ের মতো সেহরিতেও খেজুর পছন্দ করতেন। 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘উত্তম সেহরি খেজুর এবং উত্তম তরকারি সিরকা। আল্লাহতায়ালা সেহরি গ্রহণকারীদের প্রতি দয়া করুন। ’(কানজুল উম্মাল: ২৩৯৮৩)

সেহরির খাবার যাই হোক না কেন, নবী কারীম (সা.) নিয়মিত সেহরি গ্রহণ করতেন এবং সাহাবীদেরও সেহরি গ্রহণের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা সেহরি গ্রহণ করো,কেননা সেহরিতে বরকত রয়েছে। (বোখারি: ১৯২৩, মুসলিম ১০৯৫)

নবী কারীম (সা.) সেহরি খেতেন রাতের শেষ ভাগে সুবহে সাদিকের আগ মুহূর্তে। হজরত যায়েদ বিন সাবেত (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুলের (সা.) সঙ্গে সেহরি খেতাম, এরপর তিনি সালাতের জন্য দাঁড়াতেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফজরের আজান ও সেহরির মাঝে কতটুকু ব্যবধান ছিলো? তিনি বললেন, পঞ্চাশ আয়াত (পাঠ করা) পরিমাণ। (বুখারিরমজানের দিন

সেহরির পর যখন ফজরের আজান হতো, নবী কারীম (সা.) নামাজ আদায় করে নিতেন। দিনের আলো ফুটলে সাহাবীদের রমজান ও রোজা সংক্রান্ত মাসআলা শিক্ষা দিতেন। 

হজরত লাকিত বিন সাবিরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) বলেন, তোমরা ভালোভাবে নাকে পানি পৌঁছাও,তবে রোজা অবস্থায় নয়। অর্থাৎ রোজা অবস্থায় হালকাভাবে পানি পৌঁছাও, অতিরঞ্জন কোরো না। (আবু দাউদ ২৩৬৩)

সাহাবীদের রমজান সম্পর্কে সতর্ববাণীও শোনাতেন। যেমন আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি ধুলোয় ধূসরিত হোক, যার কাছে আমার নাম উল্লিখিত হলো; কিন্তু সে আমার ওপর দরুদ পাঠ করেনি। ওই ব্যক্তি ধুলোয় ধূসরিত হোক, যার কাছে রমজান মাস এলো অথচ তার গুনাহ মাফ হওয়ার আগেই তা অতিবাহিত হয়ে গেল। ওই ব্যক্তি ধুলোয় ধূসরিত হোক, যার নিকট তার বাবা-মা বৃদ্ধে উপনীত হলো; কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করায়নি (সে তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে জান্নাত অর্জন করেনি)। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫)

রোজা অবস্থায় রাসুল (সা.) মেসওয়াকের খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন; অন্যদেরও উৎসাহ দিতেন। আমের বিন রাবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রোজা অবস্থায় রাসুলকে (সা.) এতো বেশি মেসওয়াক করতে দেখেছি, যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। (আত তালখইফতার

রোজাদারের জন্য ইফতার বড় আনন্দের। ইফতার সারাদিনের রোজার ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে মনে অপার্থিব আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে। রোজাদার কেমন আনন্দানুভব করে তা কেবল যারা রোজা রাখে তারাই অনুধাবন করতে পারেন। হাদিসে বলা হয়েছে, রোজাদারের জন্য দুইটি আনন্দ- একটি ইফতারের সময় ও অপরটি যখন আল্লাহর সঙ্গে মিলবে তখন। (বোখারী, ১৯০৪)

স্বাভাবিকতই ইফতারে খেজুর অত্যন্ত উপযোগী উপকরণ। এটি শর্করা ও পুষ্টি উপাদানের উৎস হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা রাসুলের ( সা.) অভ্যাস ছিলো। 

আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকতো, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে।’ (সুনানে তিরমিজি; রোজা অধ্যায় : ৬৩২)

অনতিবিলম্বে ইফতার করা মহানবীর (সা.) সুন্নত। রাসুলের (সা.) বিভিন্ন হাদিস থেকে ও সাহাবিদের আমল থেকে এমনটাই প্রমাণ হয়। সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যতদিন মানুষ অনতিবিলম্বে ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে।’ (সহিহ তাহাজ্জুদ

রবের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরীর অন্যতম মাধ্যম হলো তাহাজ্জুদ। তাহাজ্জুদ অত্যন্ত মূল্যবান আমল। কুরআন মাজীদে নবী কারীমকে (সা.) তাহাজ্জুদের বিশেষ হুকুম করা হয়েছে। তাহাজ্জুদের সময় তথা রাতের শেষ ভাগে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি নিবিষ্ট থাকে। 

আল্লাহ তাআলা বান্দাকে ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, আছে কি কেউ, যে আমাকে ডাকবে অমি তার ডাকে সাড়া দিব। কেউ আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দিয়ে দিব। কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।

রাতের দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ফজর পর্যন্ত প্রতি রাতে রাব্বুল আলামীন এভাবে বান্দাকে ডাকতে থাকেন। (বোখারি, ৬৩২১; মুসলিম, ৭৫৮)

রাসুল (সা.) সব সময় তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। রমজানে তাহাজ্জুদের নামাজে আরও বেশি মগ্ন হয়ে যেতেন। রমজানে কখনো তার তাহাজ্জুদ না ছুটতো না। রাতের শেষ অংশে তাহাজ্জুদের জন্য তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন। 

আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) রমজান মাসে ও অন্য সব মাসের রাতে ১১ রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন। এ চার রাকাত আদায়ের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। এরপর তিন রাকাত আদায় করতেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কি বিতর নামাজ আদায়ের আগে ঘুমিয়ে পড়েন? নবী (সা.) বললেন, আমার চোখ ঘুমায়, আমার অন্তর ঘুমায়তারাবি

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজানের দিবসের রোজাকে ফরজ করেছেন। আর তার হাবীব (সা.) ‘কিয়ামে রমজান’-এর ঘোষণার মাধ্যমে তারাবির মতো মূল্যবান এ তোহফা দান করেছেন। 

তারাবিতে কালামুল্লাহর সঙ্গে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এর মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মাফ হয়। নবীজী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে কিয়ামে রমজান আদায় করবে তার বিগত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহিহ বোখা

ইসলামে দান-সদকা ও অন্যকে সহযোগিতার গুরুত্ব অনেক বেশি। আর রমজানে দানের গুরুত্ব আরও বেশি। এ মাসকে দানের মাস বলা হয়, কেননা এ মাসে একটি নফল ইবাদত করলে একটি ফরজের সমান সওয়াব। আর একটি ফরজ ইবাদত করলে ৭০টি ফরজের সওয়াব দেওয়া হয়। 

প্রিয় নবীজি (সা.) স্বভাবগতভাবেই মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল ছিলেন। রমজান মাস এলে তার দানের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যেত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মানুষের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। রমজান মাসে জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে কল্যাণবহ মুক্ত বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। (বোখা


নবী কারীম (সা.) সব সময়ই কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কয়েকটি প্রিয় জিনিসের মধ্যে কুরআন মাজীদের তেলাওয়াত ছিলো অন্যতম। আর রমজান আসলে তিনি তেলাওয়াত আরও বাড়িয়ে দিতেন। কারণ রমজান মাসেই আল্লাহতায়ালা কুরআন নাজিল করেছেন। 

আল্লাহতায়ালা বলেন, রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য হেদায়েতের দিশারী, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের যে এ মাস লাভ করবে, সে যেন তাতে অবশ্যই রোযা রাখে। বাকারা (২) : ১৮৫

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান এলে প্রতি রাতে নবীজির (সা.) কাছে জিবরাইল (আ.) আগমন করতেন। একে অপরকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন।’


ইতিকাফ তাকওয়া অর্জনের বড় মাধ্যম। নির্জনতায় প্রভুকে স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ উপায়। প্রভুর দরবারে নিজেকে মেলে ধরার অবারিত সুযোগ। নবীজী প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। 

আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন,নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবীজীর পর তার স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন। (সহিহ মুসলিম, ১১৭২)

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে রমজানের মূল্যবান সময়গুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুক। োখারি : ৩৫৫৪)