পর্তুগাল জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলবেন হবিগঞ্জের রুপু

বাংলাদেশ জাতীয় অনুর্দ্ধ ১৫ ও ১৭ দলের সাবেক খেলোয়াড় আশরাফুল মামুন রুপু ইউরোপিয়ান দেশ পর্তুগালের জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়েছেন। রুপু বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার জন্য যখন সম্ভবনার সৃষ্টি করেছিলেন, তখন ইনজুরি ও পারফরমেন্সের ঘাটতির কারণে তাকে ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছিল। তারপর ২০১৮ সালের শেষদিকে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপের দেশ পর্তুগালে চলে যান তিনি। সেখানে গিয়ে আবারো ক্রিকেট মাঠে নেমে পড়েন আশরাফুল মামুন রুপু। হাঙ্গেরিতে আগামী ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ত্রি-দেশীয় টুর্নামেন্টের জন্য পর্তুগিজ জাতীয় ক্রিকেট দলে ডাক পেয়েছেন অলরাউন্ডার রুপু। টুর্নামন্টের অপর দল সুইডেন।

আশরাফুল আলম রুপু হবিগঞ্জের নিউ মুসলিম কোয়ার্টার এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার মো. আব্দুল মোনায়েম ও মরহুমা আশরুফা সুলতানার ছেলে। গ্রামের বাড়ি বানিয়াচং উপজেলার মিয়াখানী মহল্লায়। পর্তুগিজ দলে সুযোগ পাওয়ার খবর জানার পর হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গণসহ সর্বত্র আনন্দ বিরাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসছেন আশরাফুল রুপু।

পর্তুগাল জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ নিয়ে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে গতকাল শুক্রবার এই প্রতিবেদককে আশরাফুল রুপু তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, আমার খুবই ভাল লাগছে। আমার পরিবারের লোকজনও খুব খুশি। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট অনুর্দ্ধ ১৫ ও ১৭ দলে খেলেছি। কিন্তু এ্যাংকেল ইনজুরি ও বাজে পারফরমেন্সের জন্য অনুর্দ্ধ-১৯ দলে ডাক পাইনি। এরপর নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে ২০১৮ সালের শেষের দিকে পড়াশোনার জন্য পর্তুগালে চলে আসি। সেখানে বন্ধুদের মাধ্যমে বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট ক্লাবে যুক্ত হই। এরপর দুই বছর ক্রিকেটে মনোনিবেশ করি। এরই ফলস্বরূপ পর্তুগাল জাতীয় ক্রিকেট টিমে সুযোগ পাই।

আশরাফুল রুপু তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে বলেন, হবিগঞ্জ জেলা ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ইব্রাহিম খলিল সোহেল ভাইর মাধ্যমে শাপলা সংসদে যুক্ত হই। পরে হবিগঞ্জ জেলা ও সিলেট বিভাগীয় অনুর্দ্ধ-১৫ দলে সাফল্য পাই। এ কারণে জাতীয় অনুর্দ্ধ-১৫ দল ও পরে অনুর্দ্ধ-১৭ দলে খেলার সুযোগ হয়। কিন্তু এরপর বাংলাদেশের ক্রিকেট আর এগুতে পারিনি। যে কারণে আমি ও আমার পরিবারের লোকজন হতাশ ছিলাম। কিন্তু এখন পর্তুগাল দলে সুযোগ পাওয়ায় আবারো আমার সামনে নিজেকে মেলে ধরার একটা সুযোগ এসেছে।

হবিগঞ্জ জেলা ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক পেসার ইব্রাহিম খলিল সোহেল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, রুপু বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন অন্যতম অলরাউন্ডার হিসেবে স্থান করে নিবে, এই প্রত্যাশাতেই ছিলাম। কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন পর্তুগাল জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ করে নিয়ে নিজের অদম্য ইচ্ছা ও পরিশ্রমের উদাহরণ হয়েছে আমাদের রুপু। সে এখন ইউরোপের ক্রিকেটে সৌরভ ছড়িয়ে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করবে।

ইব্রাহিম খলিল সোহেল বলেন, একদিন আমি বাড়িরে উঠোনে আশরাফুল মামুন রুপুকে বল করতে দেখে বলেছিলাম- ‘ভাই তোর বল তো অনেক ভাল। কাল মাঠে আসিস। এরপর শাপলা সংসদের হয়ে কিশোর বয়সে দারুণ পারফরমেন্স করেছিল। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। জেলা দলের পাশাপাশি সিলেট বিভাগীয় বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পায় সে। বিভাগীয় দলের হয়ে আটটি একদিনের ম্যাচে ৩৩ উইকেট পায় সে। এরপর জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পায়। কিন্তু একপর্যায়ে ইনজুরি ও ফর্মহীনতা তাকে ক্রিকেট থেকে ছিটকে দেয়। তার অদম্য মনোবল তাকে আবারো ক্রিকেটে ফিরিয়ে এনেছে।

হবিগঞ্জ ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি এডভোকেট শাহ ফখরুজ্জামান বলেন, আমি যখন অনুর্ধ-১৪ জেলা দলের দায়িত্বে ছিলাম তখন রুপু আমার নজরে আসে। অনুশীলনে ভাল করায় তাকে আমি সহ-অধিনায়ক বানাই। রুপুর যোগ্যতা ছিল বাংলাদেশের সেরা অল রাউন্ডার হওয়ার। তার নিজের কিছু অবহেলার পাশাপাশি তখনকার বয়স ভিত্তিক জাতীয় দলের নির্বাচকদের তৎপরতার অভাবে সে একটি পর্যায়ে আটকে যায়। আমি আশাবাদী রুপু পর্তুগালের হয়ে ভাল নৈপুণ্য প্রদর্শন করবে।

হবিগঞ্জের নারী খেলোয়াড় ও সাংবাদিক শাকিলা ববি তার ফেসবুক পোস্টে লিখে, হবিগঞ্জের যারা মাঠের মানুষ বিশেষ করে জালাল স্টেডিয়ামের খেলোয়াড় তাদের অবশ্যই মনে হবে জুনিয়রদের মাঝে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল রতন আর রুপু। আমি যখন অনিককে (জাকের আলী অনিক) নিয়ে নিয়মিত মাঠে যাই তখন রুপু রীতিমত হবিগঞ্জের তারকা খেলোয়াড়। বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৫ ও ১৭ দলের খেলা নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে তুমুল ব্যস্ত সে। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৯ দলে যখন রুপু ডাক পায়নি তখন হবিগঞ্জের একজন সিনিয়র ও ক্রীড়া অঙ্গনের বয়লা গুজব ছড়াতে শুরু করলো ‘রুপুর খেলা নাকি মুখে আইসা পড়ছে, এই জন্য সে ভাল খেলতে পারতেছে না।’ ওই লোক ওই সময় তখন বিভিন্নজনের কাছে বলে বেড়াতো রুপুর ক্যারিয়ার শেষ। সে এসব কেন বলতো জানি না। হয়তো রুপু তার ডাকে কখনো সারা দেয়নি তাই। যাই হোক অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ না পেলেও ঘরের মাঠে কে আটকায়। তখন হবিগঞ্জের প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে শাপলা সংসদের হয়ে ব্যাটিং এবং বোলিংয়ে মাঠে রীতিমত ত্রাস ছিল রুপু। অপজিশন টিমের খেলোয়াড় চাপে থাকতো। সাইডলাইন থেকে টিম ম্যানেজমেন্ট বা অন্য খেলোয়াড় বলে দিত ‘রুপুর আর এক ওভার আছে দেখে খেল, পরের ওভারে মারতে পারবি।’ মাঠের সবাই জানতো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে রুপুর এক ওভার। এরকম আরও অনেক রেকর্ড আছে রুপুর। কথায় অছে না, ঢেঁকি যদি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে তাহলে রুপু কিভাবে ক্রিকেট ছাড়বে। জীবন জীবিকার তাগিদে প্রবাসে গেলেও ক্রিকেট থেকে সে দূরে থাকতে পারেনি। যার মধ্যে প্রতিভা আছে সেটা পরিস্ফুটিত হওয়ার জন্য নিদিষ্ট কোনো স্থানের প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই থাক রুপু তার প্রতিভা মেলে ধরবে। রুপু ইউরোপিয়ান দেশ পর্তুগালের জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়েছে শুনে মনে হয়েছে নিজের জাত চিনিয়েই দলে জায়গা করেছে সে। তর জন্য ভালবাসা ও শুভ কামনা রইলো। দেশের হয়ে না খেললেও তর প্রতিটি ভাল পারফরমেন্স দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।

আশরাফুল মামুন রুপুর এ সফলতায় তার পরিবারের লোকজন উচ্ছ্বসিত। তারা দেশবাসীর কাছে তার জন্য দোয়া চেয়েছেন।

আইসিসির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, পর্তুগাল জাতীয় ক্রিকেট দলে ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) সহযোগী সদস্য হয়। টি-২০ ফরম্যাটে আইসিসির র‌্যাংকিংয়ে ৪৪তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। এখন পর্যন্ত ২২টি আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচ খেলেছে দেশটি। যার মধ্যে ১৮টি জয় ও ৪টি পরাজয় রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর স্পেনের সাথে প্রথম আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচ খেলে পর্তুগাল।