সততার রাজনীতি: আমার বাবা ও কষ্ট

নন্দিত ডেস্ক:গণতন্ত্র, রাজনীতি এবং আন্দোলন এই শব্দগুচ্ছের সঙ্গে জন্মের পর থেকেই আমার পরিচয়। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতির বসবাস। রাজনীতি যেন আমার রক্তের প্রতিটি কণার সঙ্গে মিশে আছে। বাবার রাজনীতি দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুধাবন করেছি যে উনার পথচলার মূলমন্ত্রই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। ভোগের রাজনীতিতে তিনি কখনোই বিশ্বাসী ছিলেন না। পবিত্র ভূমি সিলেটের পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে যাদের সুনাম রয়েছে, তিনি তাদের অন্যতম একজন। আমার বাবা আ ন ম শফিকুল হক, এককালে সাংবাদিকতাও করেছেন। ষাটের দশকে সাপ্তাহিক বাংলার বাণী ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে সাপ্তাহিক খবর ও সাপ্তাহিক সমাচারসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রের সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্টের কালো রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। খন্দকার মোশতাক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার অপশাসন বিরোধী আন্দোলনে ১৫ দল ৮ দল ও ১৪ দলে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, সমাজকল্যাণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালের কালরাতের পরবর্তী সময়ে পুলিশ তাকে আটক করে নির্যাতন করে। বিশেষ করে ১৯৮৭ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কারণে দীর্ঘদিন কারাবরণ করেন তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য আ ন ম শফিকুল হক। ২০০৬ সালে ১/১১ এর সময় সেনা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ার পাশাপাশি আন্দোলন চালিয়ে যান। প্রায় ১০ বছর সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৬ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে পা রাখেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনমত গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। আমার বাবা আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্য একজন, তিনি প্রায় সারাটা জীবন অত্যন্ত স্বচ্ছতার ও পরিশ্রমের সাথে জীবন অতিবাহিত করছেন। খুব কষ্ট করে আমাদের মানুষ করছেন। নীতি নিয়ে চলা, মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করা যেমন বাবা ভালবাসতেন। তেমনি কর্মীবান্ধব বন্ধু সুলভ আচরণের কারণে নেতা-কর্মী সবার কাছেই তিনি খুব সমাদৃত ব্যক্তি। তিনি সমস্ত জীবনে একটি বাড়ির মালিকও হতে পারেননি। আপ্যায়ন তার বেশ পছন্দের, মিটিং শেষে কখনোই একা বাসায় ফিরতেন না, তার সাথে ১০/১২ জন কর্মী থাকা ছিল আমাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। নিজে কি খেলেন না খেলেন তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা তার ছিল না, কিন্তু পাশে বসা লোকদের বাসায় রান্না হওয়া সেরাটা দিয়ে আপ্যায়ন করতে অনেক ভালবাসতেন। আমার মাও যেন নিজের হাতে করা রান্না করা খাবারে অতিথি আপ্যায়নে তৃপ্তি পেতেন। মা সংসার ধর্ম পালনের পাশাপাশি বেশ কিছুদিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এছাড়া সিলেটে জাতীয় মহিলা সংস্থায় বেশ কিছুদিন কাজও করেছেন। বাবা যেহেতু রাজনীতি করেন মেহমানদের আসা যাওয়া প্রতিদিনই থাকতো বাসায়। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত একজন ত্যাগী কর্মী হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। দেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন বাবার রাজনীতির মূল প্রেরণা ও উৎসাহদাতা। জাতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবার সাথেই কাজের মাধ্যমে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। বরেণ্য রাজনীতিবিদ দেওয়ান ফরিদ গাজী, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, মরহুম শাহ এম এস কিবরিয়া, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, ওবায়দুল কাদের, ড. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সুলতান মনসুর, আব্দর রহমান প্রমুখ বড় জাতীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে উনার ছিল গভীর সম্পর্ক। ঢাকা থেকে নেতৃবৃন্দ যখন সিলেট আসতেন তখন তাদের অনেকেই আমাদের বাসায় রাত্রি যাপন করতেন। বাবা নিজে বাজারে গিয়ে শাক সবজি মাছ মাংস কিনে আনতেন। কে কি পছন্দ করতেন বাবার তা একপ্রকার মুখস্থই ছিলো। মরহুম সামাদ আজাদ চাচা আমাদের নিজের ক্ষেতের বিরুন চাল পছন্দ করতেন, আমাদের বাসায় আসলে বিরুন চালের সাথে মাছ ভাজা ছিল চাচার পছন্দ তালিকার শীর্ষে। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি আমাদের অভিভাবকও ছিলেন। বাবা যেহেতু রাজনীতি করেন তাঁর সাথে মেহমানদের আসা যাওয়া প্রায়ই থাকতো বাসায়। আগের রাজনীতি আর এখনকার রাজনীতিতে যেন রাত-দিন ফারাক। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা আজ নিজ দলে কোণঠাসা আর ভুঁইফোড় সুবিধাভোগীরা বিপুল দাপটে, অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতায় পরিপুষ্ট। ত্যাগীরা বঞ্চিত-নিপীড়িত, তাদের মুখে শুধুই হতাশার সুর। বিভিন্ন কমিটিতে ভুঁইফোড় সুবিধাভোগীরা দুর্নীতি-অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই দেখে নিবেদিতপ্রাণ নেতারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে হচ্ছেন নির্যাতিত। তাদের অনেকে ক্ষোভে-দুঃখে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন, কেউ কেউ আবার অন্য দলেও যোগ দিয়েছেন। এই অবস্থা আওয়ামী লীগের ও অঙ্গ সংগঠনেও। দুর্বলতা ও ইমেজ সংকটকে আড়াল করার জন্য নিয়োজিত হয়ে ১৯৮৪ সালে বাবা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে ১৯৮৬ সাল, ১৯৯১ সাল, ১৯৯৬ সাল এবং ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু যথাক্রমে সর্বজনাব ইনামুল হক চৌধুরী, বাকশালের লুৎফুর রহমান, বাকশাল থেকে যোগদানকারী শাহ আজিজুর রহমানকে নমিনেশন দেওয়া হয়। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৬ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন এখানেও বিলেত ফেরত শফিক চৌধুরীকে নমিনেশন দেওয়া হয় যদিও ১/১১র সেনা শাসনের কারণে নির্বাচন হয় নাই। ২০০৮ সালে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাবা আবার নমিনেশন চান, আবারো শফিক চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ২০১১ এবং ২০১৫তে আরো দুটি নির্বাচন নির্বাচন হয়। সবকটিতেই বাবা নমিনেশন চেয়েছেন। ২০০২ সালে আমার বাবা আ ন ম শফিককে সভাপতি ও ইফতেখার হোসেন চাচাকে সাধারণ সম্পাদক করে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়েছিলো। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে পরবর্তী সম্মেলন সম্পন্ন করে কমিটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সেই কমিটি আর আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন কমিটিকে ঝুলিয়ে রেখে ২০০৯ সালে সেই কমিটি ভেঙে দিয়ে জনাব জহির চৌধুরীকে সভাপতি ও শফিকুর রহমান চৌধুকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা থেকে ১৫০ সদস্যের সিলেট জেলা কমিটি করে দোয়া হয়। দেখা যায় কমিটি গঠনকালেও অনেক স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম হয়েছে। এ নিয়ে তখন কথাও উঠেছিল। তখন অভিযোগ কেউ আমলে নেননি। আর এই কমিটির দীর্ঘ ৭/৮ বছরে সিলেটে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম মোটেই বৃদ্ধি পায়নি বরং সংকুচিত হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলের অভিজ্ঞ সৎ ত্যাগী নবীন-প্রবীণ কর্মীদেরকে নাকচ করে অনুপ্রবেশকারী সুবিধাভোগীদেরকে সুকৌশলে স্থান করে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি এখন পর্যন্ত কোন উপজেলা কমিটি গঠন করাও সম্ভব হয়নি।