মায়ের গর্ভে যেভাবে শিশুর ব্রেইন তৈরি হয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক : ধরুন আমি আপনাদের বললাম, এক সেকেন্ড সময় নিয়ে ১,২,৩...এভাবে ১ বিলিয়ন পর্যন্ত একটানা গুনতে থাকুন। আপনারাও তাই শুরু করলেন। জানেন এক বিলিয়ন পর্যন্ত গোনা শেষ করতে কত সময় লাগবে? গুনে গুনে প্রায় ৩৮ বছর! আশ্চর্য হচ্ছেন তাই না। যদি বলি একইভাবে নন স্টপ ১,২,৩...করে ১০০ বিলিয়ন পর্যন্ত গুনেন, বলতে পারেন এতে কত সময় লাগবে? প্রায় ৩ হাজার ৮০০ বছর! এটা কি সম্ভব? না, এভাবে এত বছর গণনা করা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু মায়ের গর্ভে একটি ব্রেইন সেল থেকে প্রথমে একটি,পরে দুটি, পরে তিনটি... এভাবে একে একে ননস্টপ প্রায় ১০০ বিলিয়ন সেল তৈরি হয় এবং সেনাবাহিনী কায়দায় মার্চ করে নিপুণভাবে যার যার অবস্থানে গিয়ে জড়ো হয়ে গঠন করে একটি পরিপূর্ণ মানব ব্রেইন। জানেন কত সময় লাগে তাতে? মাত্র ৯টি মাস। এত অল্প সময়ে মহান আল্লাহ তায়ালা কী পরিমাণ নিখুঁত ও দ্রুততার করে একটি মানব ব্রেইন তৈরি করে চলেছেন তা মানুষের পক্ষেই অকল্পনীয়। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় একটি ব্রেইন সেল থেকে প্রতি মিনিটে প্রায় আড়াই লাখ নিখুঁত ব্রেইন সেল তৈরি হয়। এরা যার যার এরিয়ায় চলে। যারা আবার কাজ ও গঠনে থাকে গ্রুপে গ্রুপে সম্পূর্ণ আলাদা এবং মাত্র নয় মাসে জড়ো হয়ে দেড় কেজি ওজনের পরিপূর্ণ একটি মানব ব্রেইন এ পরিণত হয়। আর এই একটি ব্রেইন প্রতি মুহূর্তে একসঙ্গে কয়েক হাজার সুপার কম্পিউটারের চেয়েও দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারে। এটা সৃষ্টির অপার এক বিস্ময়। ব্রেইনের এই দ্রুততম নিখুঁত গঠন ও ব্রেইন সেল মার্চপাস্টে যদি এক সেকেন্ডের জন্য এদিক-সেদিক তারতম্য হয় তাহলে একটা মানুষ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়, এবং ব্রেইনের গঠন ও বিকাশজনিত নানান জটিল রোগে ভোগেন। সুতরাং নবজাতকের সুস্থ সুন্দর নিখুঁত ব্রেইন গঠনে গর্ভাবস্থায় প্রতিটি মুহূর্তে মায়ের যত্ন ও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এবার আসি আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয়ে- ২ বছর বয়সের একটি মেয়েশিশুর এবং ২ বছর বয়সের একটি ছেলেশিশুর চালচলন কথাবার্তা উপস্থিত-বুদ্ধিকে তুলনা করলে ছেলেশিশুটিকে মনে হয় একটু পিছিয়ে আছে। কেমন যেন একটু সাদাসিধে প্রকৃতির। মেয়েশিশুকে বোঝা যায় একটু পাকা তীক্ষ্ণ। বিষয়টি আসলে কেন ঘটে? কি এর নিগূঢ় রহস্য? আমার কাছে অনেক অভিভাবক বিশেষ করে মায়েরা এসে উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেন, "এই একই বয়সে আমার মেয়েটি ছিল কেমন চটপটে, চপল চঞ্চল, কথাবার্তায় মুখে যেন ফুটেছে খই, কিন্তু ছেলেটিকে মনে হচ্ছে কেমন জানি একটু স্লো, কথাবার্তা পরিষ্কার হচ্ছে না এখনো, স্যার আমার ছেলেটি কি তাহলে ভবিষ্যতে কিছুটা হাবাগোবা হয়ে যাবে...!", "ইজ দা মাইল স্টোন অব ডেভেলপমেন্ট অব দিস বয় স্লো? ওর উইল হি বিকাম মেন্টালি রিটার্ডেড ইন দা লং রান...?" না, ভয়ের কোনো কারণ নেই। এটাই নরমাল। শিশু অবস্থায় মেয়েদের ব্রেইনের কিছু কিছু এরিয়া ছেলেদের তুলনায় দ্রুত ও নিখুঁতভাবে কার্যক্ষম হয়ে যায়, যার জন্য এমন হয়। এমনকি পরিণত বয়সেও মেয়েদের ব্রেইনের কিছু কিছু এরিয়ে ছেলেদের তুলনায় অত্যন্ত সুগঠিত থাকে যেমন কথাবার্তা বলার এরিয়া, যুক্তিতর্কের এরিয়া, গাণিতিক ও জ্যামিতিক বিষয় সমাধান করার এরিয়া। বিশেষ করে ব্রেইনের হিপোক্যম্পাল এরিয়ার ঘনত্ব, পুরুত্ব ও অন্যান্য এরিয়ার সঙ্গে এর সংযোগ ছেলেদের তুলনায় সুগঠিত। তাই মেয়েরা পারিপার্শ্বিক থেকে ইনফরমেশন কালেকশন ও ইন্টারপ্রেটেশনে ছেলেদের থেকে এগিয়ে। এছাড়া ব্রেইনের কথা বলার এরিয়া টাও মেয়েদের বেশি একটিভ। আর সে জন্যই তর্ক করা, কথা বলা,গালগপ্প করা, রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া, গাণিতিক হিসাব-নিকাশ সম্পর্কিত যেসব চাকরি যেমন ব্যাংকার/পরিসংখ্যানবিদ ইত্যাদিতে মেয়েরা ছেলেদের থেকে ভালো করে থাকে। এমনকি মেয়েদের ব্রেইনে ব্যথা, দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতাও ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এটা ঠিক যে ছেলেদের ব্রেইন মেয়েদের ব্রেইনের তুলনায় আকার আকৃতি ও ওজনে একটু বড়। সেটা ছেলেদের সুগঠিত মাংসপেশি নিয়ন্ত্রণ কারি ব্রেইনের এরিয়াগুলোর জন্য। সুতরাং, ব্রেইনের আণুবীক্ষণিক গঠন বলে দেয় ছেলেদের পক্ষেই ভারি কাজগুলো করা মানায়। মেয়েদের মানায় ছোট ছোট ক্যালকুলেটিভ টাইপের কাজে। শুরুতেই বলেছি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেড় কেজি ওজনের একটা মানব ব্রেইনে রয়েছে মোট ১০০ বিলিয়ন নার্ভ সেল যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ গুণ। আর গর্ভাবস্থায় প্রতি মিনিটে প্রায় ২,৫০,০০০ নতুন ব্রেইন সেল তৈরি হতে থাকে। জন্মের পর তা অল্প কিছুদিন পর্যন্ত চলতে থাকে। এই ১০০ বিলিয়ন নার্ভসেলকে সচল রাখতে ব্রেইনে রয়েছে প্রায় ১,০০,০০০ (এক লাখ) মাইল দীর্ঘ রক্তনালি। ব্রেইনের মূল কাজ হলো পরিবেশ থেকে এবং সারা শরীর থেকে সব ইনফরমেশন সংগ্রহ করা। সেগুলো ইন্টারপ্রেট করা এবং সবশেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। শরীরের যে কোনো এক স্থান থেকে ব্রেইনে ইনফরমেশন পৌঁছায় ঘণ্টায় প্রায় ২৮০ মাইল বেগে। আর বাহির থেকে চোখ, কান, ত্বক ও ঘ্রাণের মাধ্যমে সরাসরি ইনফরমেশন পৌঁছায়। ব্রেইন ছাড়া মানব অচল। সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষের ব্রেইনের গঠনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য বোধহয় জগতে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। আমাদের ব্রেইন মুহূর্তেই শরীরের যে কোনো স্থানের ব্যথা অনুভব করলেও ব্রেইন তার নিজের কোনো অংশের ব্যথা বুঝতে পারে না। অর্থাৎ ব্রেইনের নিজের ব্যথা বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই, কারণ ব্রেইনে পেইন রিসেপ্টর নেই। সে জন্য দেখা যায়, ব্রেইন স্ট্রোক করা রোগীর ব্রেইনে টেনিস বল বা তার চেয়ে বড় আকৃতির জমাট রক্তের চাকা অথবা ব্রেইনের ভেতর টিউমার থাকলে ব্রেইন সেটা আদৌ টের পায় না বা ব্যথা অনুভব করে না! ব্রেইন সেল একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার আর পুনর্জন্ম হয় না। সে জন্য একবার ব্রেইন স্ট্রোক হলে আজীবন তার লক্ষণ থাকে। তবে স্ট্রোকে ব্রেইনের সেল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর রহস্যজনকভাবে পাশের সেলগুলো কর্মক্ষমতা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে। যার কারণে কিছুটা মরে যাওয়া ব্রেইন সেলের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে যায়। সে জন্য ব্রেইন স্ট্রোকের রোগীরা নানান রকম ফিজিওথেরাপি/ব্যায়ামে ধীরে ধীরে কিছুটা উন্নতি লাভ করেন। মানুষের ব্রেইন এক হাজার সুপার কম্পিউটারের চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে পারে। মহাবিশ্ব ও মানব ব্রেইন, এ দুইয়ের রহস্যময় গঠন পরম করুনাময় আল্লাহ তায়লার এক অপার বিস্ময় যার রহস্য উন্মোচন করা মানবজাতির পক্ষে সম্ভব নয়। ব্রেইন যেভাবে বৃদ্ধি পায় শব্দ করে পড়ার অভ্যাস এবং গঠনমূলক গল্প শিশুর ব্রেইন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার শিশুদের প্রতি নেগেটিভ আচরণ ও শিশু নির্যাতন শিশু ব্রেইন বিকাশ মারাত্মক ব্যাহত করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্রেইনের কার্যক্ষমতা কমে যায়। যে কয়টি অভ্যাস ব্রেইনকে দীর্ঘদিন কর্মক্ষম রাখতে পারে, তাহলো নিয়মিত শরীর চর্চা, নিয়মিত পড়াশোনা করা, সুচিন্তায় মনকে ব্যস্ত রাখার অভ্যাস। এছাড়াও নিয়মিত ঘুম, সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, পরিমিত সুষম খাবার ব্রেইনের জন্য বিশেষ উপকারী। ডা. মো. সাঈদ এনাম সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যান্ড নিউরোলজিস্