টাঙ্গুয়া হাওরে তিন বছরে ৪ পর্যটকের মৃত্যু

মোহনীয় টাঙ্গুয়া হাওর, রূপের নদী যাদুকাটা, শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী লেক) ও পাটলাই হাওর পর্যটন স্পটে গত তিন বছরে ৪ পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই চারজনেরই রাত্রীযাপন শেষে হাওর, লেক ও পাহাড়ি নদীতে সাতার কাটতে গিয়ে সলিল সমাধি হয়। সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট রাতে মারা যান রাজধানীর তিতুমির কলেজের বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জাহেদ চৌধুরী। পরদিন ১৪ আগস্ট বিকাল ৪ টার দিকর সীমান্তের শহীদ সিরাজ লেকের পাশের পাটলাই নদীতে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একের পর এক এমন দুর্ঘটনার পরপেক্ষিতে টাঙ্গুয়া হাওর, শহীদ সিরাজ লেকসহ এখানকার পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের রাত্রী যাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে উপজেলা প্রশাসন। সোমবার (১৭ আগস্ট) দিনভর টাঙ্গুয়ার হাওরের আশপাশের জনপদে মাইকে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন নিষেধাজ্ঞা মাইকে প্রচার করা হয়। জানা গেছে, গত ১৩ আগস্ট ২০-২৫ জন বন্ধু বান্ধব মিলে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আশপাশের পর্যটনস্পটে দিন কাটিয়েছেন রাজধানীর তিতুমির কলেজের বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জাহেদ চৌধুরী (২৫)। তারা রাত কাটায় শহীদ সিরাজ লেকের পাশের পাটলাই নদীতে ট্রলারের মধ্যে। পরদিন সকালে ফেরার সময় তাহিরপুরে এসে তীরে ভেড়ানোর পর সাথের বন্ধুরা দেখতে পায় জাহেদ ট্রলারে নেই। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বিকালে জাহেদের লাশ পাওয়া যায় পাটলাই নদীতে। ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাতে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ সীমান্তের পর্যটন স্পটে বেড়াতে এসে জাদুকাটা নদীর চোরাবালিতে ডুবে মারা যান জগন্নাথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান মৃদুল (২৫)। ২০১৭ সালের ২৮ জুন রাতে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের নীচে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় সিলেটের একটি কলেজের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলামের (২২)। আশরাফুল ইসলাম জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরস গ্রামের চান মিয়ার ছেলে। একই বছরের ৫ আগস্ট শহীদ সিরাজ লেকে ডুবে মৃত্যু হয় ঢাকার ডেসকো কোয়ার্টারের বাসিন্দা বেসরকারি কোম্পানীতে কর্মরত বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ওয়াহিদ খলিলের (২৮)। বছরে বছরে এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের বাসিন্দারা। স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকদের অনেকেই সাঁতার জানেন না। তারা দল বেঁধে এসে রাত্রীযাপনকালে অসাবধানবসত পানিতে পড়েই ডুবে মারা যাচ্ছে। এজন্য টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আশপাশের পর্যটনস্পটে রাত্রী যাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পুলিশ। তাহিরপুর থানার ওসি মো. আতিকুর রহমান বলেন, অত্যাধুনিক বজরায় বা ট্রলারে দল বেঁধে রাত্রী যাপনের সময় হৈ-হুল্লোড় করে অনেকে পানিতে পড়ে যায়। এসময় সকলের অলক্ষ্যেই কেউ কেউ ডুবে মারা যান। এ জন্য আমরা মনে করছি, পর্যটকরা রাতে হাওরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। দিনে হাওরে কাটিয়ে রাতে লোকালয়ে যেন থাকেন পর্যটকেরা। এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়ে সোমবার হাওরপাড়ে এবং তাহিরপুর উপজেলা সদরে মাইকে প্রচারণা দেওয়া হয়েছে। এদিকে, আগামী ৩০ আগস্টের পর থেকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে, সামাজিক দুরত্ব মেনে, পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে পর্যটকদের চলাচলের অনুমতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শরিফুল ইসলাম সোমবার এই তথ্য জানান। এর আগে করোনার বিস্তার ঠেকাতে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ গত ১৯ মার্চ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ দর্শনীয় স্থানগুলোয় পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। উল্লেখ্য, অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে এবার সৌন্দর্য্য বেড়েছে তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আশপাশের পর্যটন স্পটগুলোতে । প্রকৃতি যেন নিজের মতো করে অপরূপ সাজে সেজেছে। হাওরে এবার বিশাল জলরাশি। গাছাগাছালিও যেন সবুজের ছায়ায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে এই মৌসুমে পর্যটকদের কোলাহল কম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে এই লীলাভূমিতে । দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ সবচেয়ে বড় জলাভূমি বিশ্বের অন্যতম রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর। জল, জোছনা আর ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের সৌন্দর্য একসঙ্গে দেখা যায় এখানে। পর্যটকদের প্রিয় এই জলরাশি এবং মেঘালয় পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য্য যেন নীরব আকাশ দেখছে। সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। ছয়কুড়ি বিল, নয়কুড়ি কান্দার সমন্বয়ের এ হাওরের দৈর্ঘ্য ১১ এবং প্রস্থ ৭ কিলোমিটার। শীত, গ্রীস্ম ও বর্ষা একেক ঋতুতে এই হাওড় একেক রূপ ধারণ করে। এই মৌসুমে অন্যান্য হাওরের সঙ্গে মিশে এটি সাগরের রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু স্থানীয় কিছু পর্যটক ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার পর্যটক কম আসছেন।