‘অদৃশ্য সুতোর’ টানে থমকে গেছে ক্যাসিনো মামলার তদন্ত

থমকে গেছে ক্যাসিনোকাণ্ডের মামলাগুলোর তদন্ত। ‘অদৃশ্য সুতোর’ টানে থেমে গেছে শুদ্ধি অভিযান। ক্যাসিনোকাণ্ডের হোতাদের কয়েকজন ধরা পড়লেও বাকিরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেপ্টেম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয় ক্যাসিনোকাণ্ডের হোতাদের পাকড়াও অভিযান। তবে ইতোমধ্যেই জামিনে বের হয়ে গেছেন অবৈধ এ কারবারিদের তিনজন। বাকিরাও চেষ্টায় আছেন জামিনে বের হওয়ার। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে- ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতারকৃতদের অন্যতম হোতা লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও শফিকুল আলম জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থা। এমনকি জামিনে বের হওয়ার পর এ দু’জন কোথায় আছেন সে বিষয়টিও জানা নেই কারও। লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ। আর শফিকুল ইসলাম ছিলেন কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি। তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, জিকে শামীম এবং যুবলীগ নেতা খালিদসহ বর্তমানে ১০ জন কারাগারে আছেন। এর মধ্যে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট এবং জিকে শামীম অসুস্থতার দোহাই দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কেবিনে শুয়ে-বসেই দিন কাটাচ্ছেন। কারা সূত্র বলেছে, চিকিৎসা শেষে তাদের কারাগারে ফেরত পাঠাতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পাঁচ দফা চিঠি দেয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। গোয়েন্দা পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, সব মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে জামিনের বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার, এ ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের শুরুর দিকে গ্রেফতার হন অবৈধ এ কারবারের অন্যতম হোতা যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। ওই সময় তার বিরুদ্ধে হওয়া তিনটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় তদন্ত শেষে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ওই মামলায় সাজার মেয়াদও ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। বাকি দুটি মামলার তদন্ত এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। গ্রেফতারের পর গত বছরের ২৪ নভেম্বর কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার কর্তৃপক্ষ বুকে ব্যথার কথা জানিয়ে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করে। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালটির একটি ভিআইপি কেবিনে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন। কারা সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ৬ অক্টোবর প্রথম দফায় কারাগার থেকে সম্রাটকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর তাকে ফের কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর ২৪ নভেম্বর আবার তাকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়। অন্য দিকে ২০ সেপ্টেম্বর আলোচিত ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার জিকে শামীমকে (গোলাম কিবরিয়া শামীম) গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তার বিরুদ্ধে ওই সময় হওয়া একাধিক মামলার একটিরও তদন্ত এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেফতার হওয়া জিকে শামীম অসুস্থতার দোহাই দিয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি হন ৫ এপ্রিল। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালের একটি ভিআইপি কেবিনে রয়েছেন। অন্যদিকে গ্রেফতারের পর এখন পর্যন্ত কারাগারে আছেন ১০ জন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের শীর্ষ ওই কর্মকর্তা জানান, ক্যানিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর রাজধানীর মতিঝিল-বনানী থেকে শুরু করে উত্তরা পর্যন্ত অন্তত ১৫টি ক্যাসিনোর তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে মতিঝিল ক্লাবপাড়ার ইয়াংমেনস, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, সৈনিক ক্লাব, ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ অন্যতম। এ ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানোর প্রথমে গ্রেফতার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত এসব অভিযানে একে একে গ্রেফতার হন ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের গুরু বলে পরিচিতি দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, গেণ্ডারিয়া যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা দুই সহোদর এনু-রুপমসহ অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সেলিম প্রধানসহ ছাড়াও একে একে ১২ জন। এর মধ্যে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে তেজগাঁওয়ের মণিপুরীপাড়ার বাসা থেকে লোকমান হোসেনকে বিপুল পরিমাণ মদসহ গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র‌্যাব)। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করে তদন্তকারী সংস্থা। মামলাটি এখনও বিচারাধীন। অন্যদিকে গ্রেফতারের পর লোকমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে অবৈধভাবে চার কোটি ৩৪ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৮ টাকার অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। এর মধ্যেই গত ১৮ মার্চ আদালত থেকে জামিন পান লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। ১৯ মার্চ তিনি কাশিমপুর-১ কারাগার থেকে মুক্তি পান। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর ২২ সেপ্টেম্বর রাতে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ)-কে কলাবাগান ক্রীড়া চক্র থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে কলাবাগান থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা হয়। সম্প্রতি ওই মামলায় অভিযোগপত্রও দাখিল করেছে তদন্তকারী সংস্থা। মামলা দু’টির বিচার প্রক্রিয়াও চলছে। এর মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেয়ে ১ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান শফিকুল। তবে এখনও অধরা রয়েছেন ক্যাসিনোকাণ্ডের অন্যতম হোতাদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার ও কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সভাপতি কাজল ও সাধারণ সম্পাদক তুহিন, সৈনিক ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনার দায়িত্বে থাকা যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও এটিএম গোলাম কিবরিয়া। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনাকরীদের অন্যতম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোবাশ্বের, যুবলীগ নেতা সরোয়ার হোসেন মনা, সোহরাব হোসেন স্বপন, জসীম উদ্দিন, মনির, রানা, খায়রুল, ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাশিদুল হক রশিদ ভূঁইয়াসহ অনেকেই।