আকাশপথে ভাড়া বৃদ্ধির ৫ কারণ

সম্প্রতি বিশ্বের কয়েকটি রুটে বিমানভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-মধ্যপ্রাচ্যের আকাশপথে লাগামহীনভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী দেশি-বিদেশি সব এয়ারলাইন্স। মূলত: পাঁচ কারণে ভাড়া বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। এগুলো হলো- করোনা মহামারির পরবর্তী উড়োজাহাজ চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হতেই টিকিটের চাহিদা বৃদ্ধি। ট্রানজিট সুবিধার সংকট। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার পুরোদমে চলছে কর্মী রপ্তানি। ওমরা হজের অনুমতি। জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধি এবং এয়ারলাইন্সগুলোর করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধি। পাশিপাশি আইসোলেশনের জন্য সিট খালি রাখা। বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি ও এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে বিমানভাড়া অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব), বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা), হজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। এছাড়া সাধারণ যাত্রীরা এই ভাড়া নৈরাজ্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছে সংগঠনটি। অন্যদিকে বিমান ভাড়া বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন প্রবাসী শ্রমিক, সাধারণ যাত্রী, ব্যবসায়ী ও সৌদিগামী ওমরাহযাত্রীরা। যাত্রী চাহিদা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইটও বাড়াতে পারছে না। বর্তমানে সেই পরিমাণ সক্ষমতা নেই হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। দিনে বেশ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকছে বিমানবন্দর। চট্টগ্রাম থেকেও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা হচ্ছে না। অন্যদিকে জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধি এবং বিমানবন্দরের বিভিন্ন ফি বেড়ে যাওয়াকেও টিকিটের দাম ঊর্ধ্বমূখীর জন্য দায়ী বলছে এয়ারলাইন্সগুলো। মধ্যপ্রাচ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সৌদিয়া, এমিরেটস, ইত্তেহাদসহ বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স যাত্রী পরিবহন করে। করোনা মহামারির কারণে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে নিলেও ধীরে ধীরে ফ্লাইট বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আবারো বাংলাদেশের উড়োজাহাজ চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হতেই আকাশপথে ভাড়ার নৈরাজ্য শুরু হলো। যাত্রীর চাপ বৃদ্ধির অজুহাত ও অতি মুনাফার জন্য এই পথে নেমেছে উড়োজাহাজগুলো। জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে পুরোদমে চলছে কর্মী রপ্তানি। দুবাইয়ে চলছে ‘দুবাই এক্সপো’। আবার পর্যটনের জন্যও যারা এর আগে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে ভ্রমণ করতেন, তারাও এখন দুবাই যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা থেকে অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানে যেতে হলেও যাত্রীদের মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইন্সগুলোই মূল ভরসা। বাংলাদেশ থেকে যারা ইউরোপ-আমেরিকা যাচ্ছেন তারাও অধিকাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক এয়ারলাইন্সগুলোর মাধ্যমে যাচ্ছেন। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এমিরেটস এয়ারলাইন্স কিংবা কাতার এয়ারওয়েজের মতো মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এয়ারলাইন্সগুলো ভারত, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশ থেকে যাত্রী পরিবহনের সময় দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া নিচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী কর্মী ও ভ্রমণ ভিসায় প্রায় ৫ হাজার যাত্রীর চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরব ওমরা হজেরও অনুমতি দিয়েছে। করোনার পর এখন ঢাকার দূতাবাস থেকে ভিসা প্রদানের হার বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ভিসা দিচ্ছে সৌদি দূতাবাস। একদিনে ৮ হাজার ৬০০ ভিসাও দেয়া হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে প্রবাসী নতুন কর্মী হিসেবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে কেবল সৌদি আরবেই গিয়েছেন ৭১ হাজার ৭২৫ জন বাংলাদেশি। সবমিলিয়ে ঢাকা থেকে সৌদিগামী যাত্রী বেড়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ভাড়া বাড়তে থাকে। করোনার আগে ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ছিল ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এখন সেই ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৬৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। ঢাকা-দুবাইয়ের রিটার্ন ভাড়া ছিল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। এভাবেই বাহরাইন, কুয়েত, কাতার ও আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইউরোপের রুটগুলোতেও ভাড়া নিয়ে চলছে অরাজকতা। ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে কানাডায় যেতে আগে ভাড়া ছিল ৭০ হাজার টাকা। টার্কিস এয়ারলাইন্স এখন ভাড়া নিচ্ছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি। দুবাই যেতে কাতার এয়ারওয়েজের কাছে গুনতে হচ্ছে ১ লাখ ৫২ হাজার টাকার বেশি অর্থ। প্রায় প্রতিদিনই দাম বাড়ছে টিকিটের। সিট নেই, চাহিদা বেশি এসব অজুহাত দেখিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন অভিবাসী ব্যয় বেড়েছে, তেমনি অস্থিরতা ও নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে দেশের এভিয়েশন খাতে। মার্চ পর্যন্ত সৌদি আরবের টিকিট নেই ট্রাভেল এজেন্টগুলোর কাছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি দুঃখজনক। যদিও কমার্শিয়াল ইস্যুতে বেবিচকের হস্তক্ষেপ করার তেমন সুযোগ নেই। তারপরও আমরা এয়ারলাইন্সগুলোকে ডেকে ভাড়া কমানোর নির্দেশ দিয়েছি। কারণ ভারত, নেপাল, পাকিস্তান আশপাশের কোনো দেশের ভাড়া বাড়েনি। শুধু ঢাকায় কেন এত ভাড়া বাড়বে। তবে এয়ারলাইন্সগুলো উল্টো তারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের চার্জ কমানোর দাবি জানিয়েছে। এদিকে, টিকিটের দাম বাড়ানো ও আসন সংকট নিরসনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সি অব বাংলাদেশ (আটাব)। চিঠিতে আটাব বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণকারীদের অধিকাংশ যাত্রী প্রবাসীকর্মী, যারা দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। অতিসম্প্রতি দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এ কারণে প্রবাসী যাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এভাবে ভাড়া বাড়ানো অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত মনে করে আটাব। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি আটাব জানিয়েছে। ফ্লাইটের ভাড়ার প্রতি আমরাও সংবেদনশীল। আমরাও চাই যেসব কর্মী প্রবাসে যায়, তারা যেন কম ভাড়ায় যেতে পারে। আমরা এটা নিয়ে মন্ত্রণালয়েও মিটিং করেছি। ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সিভিল এভিয়েশনকেও অনুরোধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, চলতি বছরের নভেম্বরে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মী জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে গেছেন। যা করোনা মহামারীর মধ্যে নতুন রেকর্ড। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর (জানুয়ারি-নভেম্বর) ১১ মাসে যে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন তাদের মধ্যে এককভাবে সৌদি আরবেই গেছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার ১৪ জন। অর্থাৎ ৭৬ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। এছাড়া ওমানে ৪০ হাজার ৮৬ জন, সিঙ্গাপুরে ২১ হাজার ৩৩৯, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৪ হাজার ২৭৪, জর্ডানে ১১ হাজার ৮৪৫ ও কাতারে ৯ হাজার ৭২৮ জন কর্মী গেছেন। এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি মনছুর আহামেদ কালাম বলেন, তিনি বলেন, রুট ভেদে বিমান টিকিটের মূল্য দুই থেকে তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটের বর্তমান ভাড়া ‘অস্বাভাবিক’। অভিবাসীরা চরম অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যগামী নতুন যাত্রীরা বাড়িঘর বিক্রি করেও টিকিট কিনতে পারছেন না। সুদের ওপর টাকা দিয়ে অতিরিক্ত মূল্যে তারা টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আসন সংখ্যা বাড়িয়ে টিকিটের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব। হজ এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, নতুন যাত্রী ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছুটিতে আসা যাত্রীর কর্মস্থলে ফেরার হার বেড়েছে। এ সুযোগে এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করেছেন। এদিকে এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। দীর্ঘদিন বিমান বসিয়ে রেখে রক্ষণাবেক্ষণ, অফিস খরচ ও বেতনভাতা বহন করতে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের রুটে ওয়ানওয়েতে বিদেশগামীদের চাহিদা বেশি। অর্থাৎ কেবল যাওয়া টিকিটের চাহিদা থাকলেও ফিরতি ফ্লাইটে আসনের বেশিরভাগই ফাঁকা থাকে। তাই টিকিটের দাম বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া যত দেরিতে টিকিট কেনা হবে, ভাড়ার হার তত বাড়বে এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নিয়ম। আর বিমানের পরিচালন ব্যয়ের ৪০ শতাংশ হচ্ছে জ্বালানি। জ্বালানি খরচ বেড়েছে শতাংশ। সবমিলে বিমানভাড়া বেড়ে গেছে। দেশি-বিদেশি সব এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স আগামী বছরের জুন থেকে জেদ্দা, রিয়াদ ও মদিনা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম বলেন, ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ হলো করোনাকালীন বিভিন্ন নিয়য়-কানুন পরিপালন করতে গিয়ে অপারেশন ব্যয় বাড়ছে। এর মধ্যে করোনা বিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতনার জন্য সিট খালি রেখে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এসব কারণে ব্যয় বেড়েছে। এর জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে। এসব কারণে টিকিটের দাম বেড়েছে। ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে ভুক্তভোগী প্রবাসী আকমল জানান, আমি করোনার আগে দুবাই থেকে ছুটিতে এসেছিলাম। গত ১৪ই নভেম্বর আমি শুধু দুবাই যাবার জন্য একটি টিকিট কিনেছি ৫০ হাজার টাকায়। অথচ এটা ছিল মাত্র ২৫ হাজার টাকা। এই ভাড়ার সংকট একেবারেই কৃত্রিম। গত অক্টোবরেও ভাড়া অনেক সহনীয় ছিল। নভেম্বরে এই অস্তিরতা দেখা দিয়েছে।