পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ

পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। একই সঙ্গে পেঁয়াজ আমদানিতে শীর্ষে বাংলাদেশ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে এখন সাড়ে ৩৩ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় চীন ও ভারতে। দেশে গত বছর পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ লাখ টনের বেশি। আমদানিতে এর পরেই আছে যুক্তরাষ্ট্র। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পেঁয়াজের ক্রমবর্ধমান ভোগ, উৎপাদন-পরবর্তী লোকসান, ভালোমানের বীজের অভাবসহ কয়েকটি কারণে চাহিদার তুলনায় দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি থাকছে। তাঁদের মতে, শুধু উৎপাদন-পরবর্তী লোকসান কমিয়ে আনতে পারলে এবং উৎপাদনের পরিমাণ আরেকটু বাড়াতে পারলে কয়েক বছরেই পেঁয়াজে স্বনির্ভর হওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, কৃষক যাতে দাম ভালো পান, সে জন্য উৎপাদন মৌসুমে আমদানি বন্ধ রাখতে হবে। দেখা গেছে, ভালো দাম পেয়ে কৃষক পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হওয়ায় গত অর্থবছরে এক লাফে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছিল আট লাখ টন। এর পাশাপাশি উৎপাদন-পরবর্তী লোকসান কমাতে কৃষকদের সচেতন করতে হবে। অনাবাদি ও চরের জমি পেঁয়াজ চাষে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভালো বীজ সহজলভ্য করতে হবে এবং উচ্চফলনশীল জাতগুলোর চাষ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের (বগুড়া) পরিচালক ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাজহারুল আনোয়ার বলেন, পেঁয়াজের মূল ঘাটতি হয় উৎপাদন-পরবর্তী লোকসান ও অবচয়ের কারণে। কয়েক ভাবে এই লোকসান হয়। সবচেয়ে বেশি হয় সময়ের ব্যবধানে পেঁয়াজের পানি শুকিয়ে। এ ছাড়া সংরক্ষণ পদ্ধতি সঠিক না হলে কিছু পেঁয়াজ পচে যায়। বাকিটা হয় মাঠে ও পাইকারি-খুচরা বাজারে। মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘কৃষকদের সচেতন করতে পারলে উৎপাদন-পরবর্তী লোকসান সর্বোচ্চ ২০ শতংশে নামিয়ে আনা যায়। তবে লোকসান হিসাব করেই আমরা চাহিদা অনুসারে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ জন্য অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আগাম পেঁয়াজ আবাদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভালো দাম পেলে কয়েক বছরের মধ্যেই তা সফল হবে।’ চাহিদা ও উৎপাদন কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২০-২১ সালে পেঁয়াজের চাহিদা ছিল ৩৫ লাখ টন। চলতি ২০২১-২২ সালের জন্য চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টন। আগামী বছর এই চাহিদা দাঁড়াতে পারে ৩৬ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে পেঁয়াজের চাহিদা থাকে তিন লাখ টনের ওপরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৩৩.৬২ লাখ টন। তাদের হিসাবে, পেঁয়াজের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ২৫-৩০ শতাংশ। সে হিসাবে নিট উৎপাদন প্রায় ২৩.৫৩ লাখ টন। রান্নার সময় ফেলে দেওয়া অংশ ও নানাভাবে হওয়া অপচয় বাদ দিলে দেশে নিট চাহিদা ২৬ লাখ ৬১ হাজার টন। অর্থাৎ দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি আড়াই থেকে তিন লাখ টন। ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পেঁয়াজ চাষের জমির পরিমাণ ৪১ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১-১২ সালে দেশে ১.৮০ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছিল। সর্বশেষ গত অর্থবছর দেশে ২.৫৩ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেন কৃষকরা। বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটাতে গড়ে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো। এর ৯০ শতাংশই আসত ভারত থেকে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। ওই বছরের নভেম্বর নাগাদ পেঁয়াজের দাম ২৮০ টাকায় ওঠে। বাজার সামাল দিতে তাত্ক্ষণিকভাবে আকাশপথে বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে হয় সরকারকে। পরের বছর দাম কমলেও ৭০ টাকার নিচে নামেনি খুচরা বাজারে। এই বাড়তি দামের কিছুটা দেশের কৃষকরাও পান। গত দুই বছর কৃষক কেজিতে ৫০ টাকা দাম পেয়েছেন বলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে। তাদের হিসাবে পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ প্রায় ২০ টাকা। তাই ২৫ টাকায় বিক্রি করতে পারলে কৃষকের লাভ থাকে।