সামাজিক মাধ্যম ও ওটিটি নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা চূড়ান্ত

বিতর্কের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ওভার দ্য টপ (ওটিটি) নিয়ন্ত্রণে খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। শিগগিরই ওই খসড়া নীতিমালা উচ্চ আদালতে দাখিল করা হবে। এর আগে খসড়া নীতিমালা প্রত্যাহার চেয়ে ৪৫ আন্তর্জাতিক সংস্থার দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বিটিআরসি’র যুক্তি-রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এটা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে উচ্চ আদালত। বিটিআরসি’র করা ওই নীতিমালার প্রস্তাবিত নাম দেয়া হয়েছে ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফরমস’। গত ৬ই ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি তাদের ওয়েবসাইটে ১৬ পৃষ্ঠার খসড়া নীতিমালাটি ইংরেজিতে প্রকাশ করে। প্রথমে ১৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই খসড়া নীতিমালার ওপর মতামত চাওয়া হয়। পরে তার মেয়াদ বাড়িয়ে ৫ই মার্চ করা হয়। খসড়া নীতিমালা নিয়ে মানবজমিনে ২৪শে ফেব্রুয়ারি বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর পরদিন থেকেই বিটিআরসি’র ওয়েবসাইট থেকে খসড়া নীতিমালাটি সরিয়ে ফেলা হয়। সেখানে শুধু মতামত চেয়ে দেয়া নোটিশটি ঝুলিয়ে রাখা হয়। খসড়া নীতিমালা সরিয়ে ফেলা প্রসঙ্গে বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অনেকেই ওয়েবসাইটে খসড়া নীতিমালাটি পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। এটা কেন পাওয়া যাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখছি। সাইটের কোনো কারিগরি ত্রুটিও থাকতে পারে বলে তারা জানান। তবে গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিটিআরসি’র ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা যায় সবকিছু ঠিক আছে শুধু খসড়া নীতিমালাটিই নেই। এদিকে খসড়া নীতিমালা প্রসঙ্গে বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র মানবজমিনকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা খসড়া করছি। তথ্য মন্ত্রণালয়ও একটি করছে। শিগগিরই খসড়া নীতিমালাটি আদালতে দাখিল করবো। এরপর আদালতের নির্দেশনা মেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। যারা বিষয়টিকে বিতর্কিত বলছেন তা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছেন তাদের দাবি মানা সম্ভব নয়। কে কি বললো সেটা এখন আমাদের দেখার বিষয় না। আদালতের নির্দেশনা মানা আমাদের কাছে সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, খসড়া নীতিমালা তৈরি করতে তিনটি দেশের নীতিমালাকে মানদণ্ড হিসেবে নেয়া হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ভারত। মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। ফ্রিডম অব স্পিসের নামে দেশবিরোধী কোনো কিছু যেন কেউ করতে না পারে সে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে মাত্র। এর আগে গত সোমবার এটি প্রত্যাহার ও পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বিটিআরসিকে চিঠি দিয়েছে ৪৫ আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা জানায়, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) প্রস্তাবিত ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফরম নিয়ন্ত্রণে খসড়া প্রবিধানমালাটি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তাকে বিপন্ন করবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে চিঠিটি প্রকাশ করা হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রবিধানটি ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের এনক্রিপশনকে দুর্বল ও অনলাইন নিরাপত্তাকে দুর্বল করবে। এ ছাড়া এটির প্রয়োগ মানবাধিকারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী, মানবাধিকারকর্মী ও সংখ্যালঘু সমপ্রদায়কে আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলবে। এই প্রবিধানগুলোর মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় তত্ত্বাবধান, স্পষ্টতা, পূর্বাভাসযোগ্যতা ও মানবাধিকার রক্ষায় যথাযথ প্রক্রিয়ার অনুসরণ ছাড়াই একটি কাঠামো বাস্তবায়ন হবে। প্রবিধানগুলো মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। বিটিআরসি’র খসড়া নীতিমালায় নানা ধরনের বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- কোনো ধর্মের অনুসারীদের আহত করে বা আঘাত দেয়- এমন কোনো মন্তব্য বা বিষয় প্রচার করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, এমন কিছু করা যাবে না। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হেয় করে মন্তব্য বা কটূক্তি করা যাবে না। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে কোনো মন্তব্য এবং খবর প্রচার বা পোস্ট করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই বিষয়গুলোকে ‘কমন’ বা সাধারণ ইস্যু হিসেবে দেখানো হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী কেউ এসব পোস্ট বা প্রচার করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে এই বিষয়গুলোতে ফেসবুক এবং ইউটিউব কর্তৃপক্ষসহ সব সামাজিক মাধ্যম এবং অনলাইনে বিনোদনের প্ল্যাটফরমগুলোকেও সজাগ থাকতে হবে। এ ছাড়া নেটফ্লিক্স, হইচই এবং অ্যামাজন প্রাইমসহ বিনোদনের ওটিটি প্ল্যাটফরমগুলোতে অশ্লীল এবং অনৈতিক কোনো কন্টেন্ট প্রচার করা যাবে না, বলা হচ্ছে নতুন নীতিমালার খসড়ায়। নীতিমালায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধু দেশগুলোর সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে- এ ধরনের মন্তব্য, খবর বা কন্টেন্ট সামাজিক মাধ্যমে বা বিনোদন প্ল্যাটফরমে প্রচার করা যাবে না। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী কেউ এটি না মানলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। নীতিমালার খসড়ায় অন্যের পরিচয়ে সামাজিক মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট বা ভুয়া অ্যাকাউন্ট বিষয়কেও অপরাধ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। কেউ অন্য একজনের নাম বা পরিচয় ব্যবহার করে ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলে তৎপরতা চালালে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যের নামে পোস্ট দিয়ে কেউ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে আসল ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব এসেছে। কোনো ব্যক্তিকে সমাজে হেয় করবে- এমন কোনো পোস্ট বা মন্তব্যও করা যাবে না।