ইমরান খানের ‘বিদায় ঘণ্টা’ বাজবে আজ!

পাকিস্তানের জনগণ আজ নতুন ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে প্রথমবারের মতো দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে বিদায় নিতে হবে। নতুন কোনো নাটকীয়তা না হলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ‘বিদায় ঘণ্টা’ আজ বাজতে চলছে। অনাস্থা ভোট খারিজ ও জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুপ্রিমকোর্ট বাতিল করলে নতুন মোড় নেয় দেশটির অস্থিতিশীল রাজনীতি।

এদিকে আদালতের আদেশে সব ছক উলটে যাওয়ার পরদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, সুপ্রিমকোর্টের দেওয়া রায় তিনি মেনে নিয়েছেন। শুক্রবারের এই ভাষণে তিনি বলেন, ‘রায়ে আমি দুঃখ পেয়েছি, কিন্তু তা মেনে নিয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে ‘আমদানি’ করা সরকার মানব না, জনগণের কাছে ফিরে যাব। এছাড়া অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের বিদায় নিশ্চিত ধরে নিয়ে সম্ভাব্য নতুন ফেডারেল সরকার গঠনের আলোচনা শেষ করেছে বিরোধী জোট। নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফ। খবর ডন ও জিও নিউজের। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী আজ পার্লামেন্টের নিুকক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য জাতীয় পরিষদের স্পিকার। ৩ এপ্রিলের আলোচ্যসূচির সঙ্গে মিল রেখে সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যেই এই অধিবেশন শুরু করতে হবে। সুপ্রিমকোর্টের আদেশে বলা হয়, ‘৩ এপ্রিলের কার্যসূচি অনুযায়ী হাউজের কার্যক্রম পরিচালনায় জাতীয় পরিষদের চলতি অধিবেশনে বৈঠক আহ্বানে স্পিকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে হওয়া উচিত, কোনোভাবেই শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার পরে নয়।’

৭ মার্চ জাতীয় পরিষদের সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় বিরোধী দলগুলো। এরপর ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্পিকার। প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির জন্য ৩ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়। ওই দিনের কার্যসূচিতে প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিসহ ছয়টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর ৩ এপ্রিল বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা দিয়ে খারিজ করে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি। একই সঙ্গে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন তিনি। তবে ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলো নিজেরাই অধিবেশন চালিয়ে যান। তারা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) আইনপ্রণেতা আইয়াজ সাদিককে স্পিকার নির্বাচিত করেন। অনাস্থা প্রস্তাব ১৯৭ ভোটে পাশ করেন। অনাস্থা প্রস্তাব পাশে ৩৪২ আসনের জাতীয় পরিষদে ১৭২ ভোট প্রয়োজন। অনাস্থা ভোট খারিজের দিনই স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) শুনানি গ্রহণ করেন সুপ্রিমকোর্ট। টানা ৫ দিনের দীর্ঘ শুনানি শেষে অনাস্থা ভোট খারিজ ও জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে বৃহস্পতিবার রায় দেন আদালত। একই সঙ্গে জাতীয় পরিষদ পুনর্বহাল করে শনিবার অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটগ্রহণের নির্দেশ দেন।

অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে ইমরান খানই হবেন অনাস্থা ভোটে বিদায় নেওয়া পাকিস্তানের প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী। এর আগে দুই প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়েও টিকে যান। সেনা হস্তক্ষেপের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা পাকিস্তানে কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তবে ইমরানকে বিদায় নিতে হচ্ছে পার্লামেন্টে আনা অনাস্থা ভোটে। ইমরানের দল আস্থা ভোটে হেরে গেলে বিরোধী দলগুলো জোট গড়ে তাদের একজন প্রার্থীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করতে পারবে। ২০২৩ সালের আগস্টে বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে, অথবা আগাম নির্বাচনও দেওয়া হতে পারে।

অর্থনীতিকে সঠিক পথে আনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন ইমরান খান। জনগণের একাংশের কাছে তার জনপ্রিয়তা এখনো অটুট থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন হারাতে শুরু করেন ইমরান। মূলত মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত বেড়ে চলা এবং বিদেশি ঋণের বোঝা তাকে সংকটে ফেলে দেয়। ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাধ পূরণ হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে টানাপড়েন শুরু হলে তার বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, বর্তমান সংকটের শুরু অক্টোবরে, যখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নতুন প্রধানের নিয়োগপত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সামরিক বাহিনীর পছন্দ করা ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিতে বাধ্য হন, কিন্তু ততক্ষণে মাঠ অনেকটা বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

সুপ্রিমকোর্টের রায় মেনে নিয়েছি : ইমরান খান শুক্রবার রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, ডেপুটি স্পিকার সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদের আলোকে পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবি এবং অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই অনাস্থা প্রস্তাবে বিদেশি হস্তক্ষেপ ছিল। আমি চেয়েছিলাম সুপ্রিমকোর্ট অন্তত এ বিষয়টিতে নজর দেবে। অন্য একটি দেশ চক্রান্ত করে পাকিস্তান সরকারের পতন ঘটাতে চায়-এটি একটি গুরুতর অভিযোগ।’

এ বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট তদন্ত করে দেখবে-এই আশাটুকু অন্তত করেছিলেন বলে জানান ইমরান। তিনি বলেন, ‘আমরা সত্য বলছি কি-না তা যাচাই করে দেখতে সুপ্রিমকোর্ট অন্তত নথিটি দেখতে পারত বা দেখার আদেশ দিতে পারত। আমি কিছুটা হতাশ হয়েছি। কারণ, এটি অনেক বড় একটি বিষয়। অথচ এটি নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে কোনো আলোচনা হয়নি।’

পাকিস্তান আমদানি করা সরকার মেনে না নেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই তারকা ক্রিকেটার আগামীকাল এশার নামাজের পর সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ডাক দেন। তিনি বলেন, আমদানি করা কোনো সরকার মেনে নেব না। এ ধরনের অবস্থায় জনগণের কাছে যাব। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, টাকার বিনিময়ে দলবদলের ঘটনায় ৬৩(এ) ধারায় সিদ্ধান্তও আমাকে হতাশ করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতি অবশ্যই দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন ইমরান খান। তিনি বলেন, যদি জাতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং দেশে অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর উন্নত না করে তাহলে কেউই তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। ইমরান দাবি করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ও মার্কিন কর্মকর্তার মধ্যকার বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আমার রাশিয়া সফর করা উচিত হয়নি। পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফের সমালোচনা করে তিনি বলেন, শেরওয়ানি পরে শপথ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকা শাহবাজ এই বিদেশি ষড়যন্ত্রে জড়িত।

সরকার চূড়ান্ত করেছে বিরোধীরা : বিরোধী জোটের সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় সরকারের মতো নতুন ফেডারেল সরকার গঠন করা হবে। এতে আনুপাতিক হারে শরিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এর মেয়াদ ৬ মাস অথবা ১ বছর রাখার বিষয়টি বর্তমানে বিবেচনায় রয়েছে। এই মেয়াদের মধ্যে নির্বাচনি সংস্কার ও জবাবদিহি-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো পাশ হতে পারে। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে নির্বাচন কমিশনকে যৌক্তিক সময় দেওয়া হবে। জাতীয় পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী। শপথ নেওয়ার পর তিনি সম্ভাব্য সরকারের অগ্রাধিকারগুলো ঘোষণা করবেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। এসব অগ্রাধিকারের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রুপির দরপতন ঠেকানোর মতো অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন থাকবে। যুদ্ধ নয়, শান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সব দেশের সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনবে সম্ভাব্য নতুন সরকার। নিপীড়নের উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর কার্যক্রম বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট এবং চারটি প্রদেশে নতুন গভর্নর নিয়োগে সাংবিধানিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইমরান খান সরকারের সব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও পরিবর্তন করা হতে পারে বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে। সরকার গঠনের পরপরই পরামর্শ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকে দেশে ফেরানোর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নওয়াজ শরিফ বর্তমানে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছেন।