রাশিয়া-ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে ইসরায়েল?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যকার বহুদিনের সংঘাত গত মাস থেকেই আরও তীব্রতর হয়েছে। গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি সেনা অবস্থানে ইরানের রকেট হামলাকেই অবস্থার পরিবর্তনের কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য এটি ছিল ইসরায়েলি বাহিনীর ইরানের অবস্থানে বিমান হামলার জবাব। আর তারপর থেকেই ইসরায়েল অনেক বেশী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া ইরানের অন্তত ৫০টি স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েল এমনভাবে বিমান হামলা চালিয়েছে যে ওইসব সামরিক স্থাপনা আবার আগের মতো অবস্থায় নিয়ে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। বিশ্লেষকরা এমনটাই মন্তব্য করেছেন। এটা এখন পরিস্কার যে ওই আক্রমণ পুরো অঞ্চলের হিসেব-নিকাশই পাল্টে দেবে-সেটি ভবিষ্যতের জন্যেও। এমনকি দক্ষিণ গোলান মালভূমি সংক্রান্ত অগ্রগতি হয়তো নতুন মাত্রা পাবে। ইসরায়েল সীমান্তবর্তী সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের এই অঞ্চল কুনেট্রা শাসনের অন্তর্ভূক্ত। যা নতুন করে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হামলার সম্মুখীন হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আসাদ সরকার সব সময়ই বিভিন্ন বাহিনীকে উৎখাত করতে প্রস্তুত থাকে, বিশেষ করে যাদের সাথে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এখানে সম্ভাব্য যুদ্ধ নতুন একটি পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াতে পারে সিরিয়ার বাইরের সেই তিন শক্তির জন্যে, যাদের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে অঞ্চলটি ঘিরে। সেই তিন দেশ হলো-ইরান, ইসরায়েল এবং রাশিয়া। এই তিন দেশের মধ্যে সম্পর্ক যে একেবারেই স্বাভাবিক নয়, তা বলাই বাহুল্য। ইরান আর ইসরায়েল তো দৃশ্যতই শত্রু। অন্যদিকে, সিরিয়া দ্রুতই হয়ে উঠছে তাদের তিক্ত সম্পর্ক প্রতিফলনের বিপজ্জনক ক্ষেত্র। রাশিয়া আর ইরান হলো আসাদ সরকারের সামরিক শক্তির প্রধান উৎস্য। এদের সমর্থন ছাড়া আসাদ সরকারের পতন অনিবার্য বলেই ধরে নেয়া হয়। এদিকে মস্কোর আবার ইসরায়েলের সাথেও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সম্প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় স্মরণে মস্কোতে এক বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু। সুতরাং কিভাবে রাশিয়া একই সাথে এই দুই বিবাদমান পক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলছে? সিরিয়ায় রাশিয়ার যে বিমানঘাঁটি আছে সেখানে আছে শক্তিশালী রাডার এবং ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপনযোগ্য ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা, যা দিয়ে সহজেই ইরানের মিত্র হিসেবে তাদের পক্ষে ইসরায়েলের যে কোনো বিমান তৎপরতা বাধা দেয়া সম্ভব। কিন্তু রাশিয়া তা কখনোই করেনি। বরং সিরিয়া এবং লেবাননের ওপর হামলার জন্যে তারা আকাশপথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে ইসরায়েলের জন্যে। এমনকি সিরিয়ায় রাশিয়া আর ইসরায়েলের প্রধান কার্যালয়ের মধ্যে স্থায়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে, যা কিনা নিশ্চিত করে ইসরায়েলি কোন হামলা যেন রাশিয়ান বিমান তৎপরতায় বাধাগ্রস্থ না হয়। সুতরাং রাশিয়ার এমন আচরণ থেকে কী বোঝা যায়? এটা কি মনে হয় যে মস্কো আর তেহরানের মধ্যকার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে? কিংবা ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যকার অঘোষিত যুদ্ধের ক্ষেত্রেই বা এটা কি ইঙ্গিত দেয়? শুরুতে এটি ছিল অনেক সরল একটি বিষয়। ২০১৬ সালের অাগস্টে আসাদ সরকার সমস্যায় পড়লে মিত্ররা এগিয়ে এসেছিলো। মস্কো পাশে দাড়িয়েছিল তার সামরিক বিমান বাহিনী দিয়ে। আর ইরান এবং তার আর কিছু সশস্ত্র মিত্র-যাদের মধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহও রয়েছে-আসাদ সরকারকে সম্মুখ সমরে শক্তি যুগিয়েছে। সিরিয়ায় ইরান এবং রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল অঞ্চলটিতে সংহতি ফিরিয়ে আনা। রাশিয়া শীতল যুদ্ধের সময়ের মতো আবারও কিছু দীর্ঘমেয়াদী মিত্রের সন্ধানে ছিল। একই সাথে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে আইএস গোষ্ঠী রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এমন ভয়ও ছিল। সিরিয়ায় রাশিয়ার একটি ছোট নৌঘাঁটিও রয়েছে- যার কলেবর আরও বাড়ানো হচ্ছে। ভূ-কৌশলগত বিবেচনায় রাশিয়া এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব আবারও ফিরে পেতে চায়, যা এখন ওয়াশিংটনের হাতে। ইরানেরও প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী মিত্র এবং তাদেরও ছিল ভূ-কৌশলগত হিসাব-নিকাশ। বিধ্বস্ত সিরিয়া ইসরায়েলের জন্য খুব বেশী মাথাব্যাথার কারণ ছিল না। কিন্তু তার পাশে থাকা ইরান-যাদের পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো সম্ভাবনা এবং ক্রমবিকাশমান সেনাবাহিনী রয়েছে, তাকে দীর্ঘমেয়াদে হুমকি হিসেবেই নিয়েছে ইসরায়েল। এভাবে যদি আসাদ সরকার স্থিতিশীল হয় এবং সেখানে ভিন্নভাবে ইরানী বাহিনীই প্রতিষ্ঠা পায়, সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের সীমান্তের জন্যে তা মোটেই সুখকর নয়। ইরান এখন ইরাকে তাদের প্রভাব বাড়াতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আসাদ সরকার যেভাবে আবারও নিজের দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে, তাতে করে ইরানকে দেশটির মধ্য দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাবার জন্যে হয়তো করিডর দিতে পারে। আর এটা সহায়ক হবে হিজবুল্লাহর জন্য। বর্তমানে ওই অঞ্চলে ইরানের বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম যায় আকাশপথে, যা যেকোন সময় বাধাগ্রস্থ হতে পারে বলে তেহরানের ধারনা। এদিকে আসাদ সরকার ধীরে ধীরে বিজয় অর্জন করতে শুরু করেছে। দেশটির বাহিনী গড়ে উঠেছে অনেকটাই ইরানী ধাঁচে, যেখানে রয়েছে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ, শিয়া মিলিশিয়া থেকে শুরু করে আছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের গোষ্ঠীও। এরই মধ্যে ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী জোর প্রচারণা চালিয়ে আসছে যে ইরান সিরিয়ায় স্থায়ীভাবে তাদের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চলেছে। ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনায় রাশিয়া আর ইসরায়েলের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সপ্তাহেই মস্কোতে সেদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাভেগডর লিবারম্যান। আর এসবই ইঙ্গিত দেয় যে ইরানী স্থাপনায় ইসরায়েলী হামলা রাশিয়াকে উদ্বিগ্ন করেছে। কেননা রুশদের আশঙ্কা হলো, যদি এই অস্থিরতা চলতে থাকে তবে তা আসাদ সরকারের ক্ষমতায় থাকার জন্যে হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এখন রাশিয়া এমন পরিকল্পনা করতে চায় যাতে করে ইরানের সমর্থনপুষ্ট বাহিনী যেন ইসরায়েলি সীমান্তে কাছাকাছি না থাকে। স্বল্পমেয়াদে এর অর্থ এই দাড়ায় যে দক্ষিণ গোলান অঞ্চলে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর কোনো তৎপরতায় ইরানী সমর্থনপুষ্ট বাহিনী থাকছে না। তবে এটি কেবল একটি সাময়িক ব্যবস্থা হতে পারে। ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানী বাহিনীর স্থায়ী অপসারণ দাবি করতে পারে। আর ইরানের ক্ষেত্রেও নিজের স্বার্থে এটি মেনে নেয়া অসম্ভব হবে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়া থেকে সব বিদেশি বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। কিছুদিন আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভও বলেছিলেন যে, দক্ষিণ অংশে শুধু সিরিয়ান বাহিনীই থাকবে। পুতিনের আহ্বান ওই কথারই যেন প্রতিধ্বনি। কিন্তু রাশিয়া ইরান ও তার মিত্রদের উদ্দেশ্য পূরণে কতটা সহায়তা করছে? মস্কো যে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পুরোপুরো বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত স্থিতিশীলতা চায়, তা বেশ স্পষ্ট। আর এক্ষেত্রে ইরান তার খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। কিন্তু ইসরায়েলের সাথে তাদের সংঘাত ওই লক্ষ্য অর্জনে দীর্ঘসূত্রতাই সৃষ্টি করবে।