ভূমিকম্প যেন তুরস্কের পিছু ছাড়ছে না!

একদিকে নিখোঁজ স্বজনদের জন্য আর্তি, অন্যদিকে লাশের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। এরই মধ্যে সোমবার রাতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় আবার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। বেশ কয়েকজন মারা গেছেনতুন করে ভূমিকম্প হওয়ায় বেঁচে যাওয়া মানুষ ও উদ্ধারকারীদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে দেবে যাওয়া ও ফাটলধরা ভবনগুলো নতুন ভূমিকম্পের কারণে দেবে গেছে। ফলে ধ্বংসস্তূপ থেকে কোনো জীবিত মানুষ অথবা লাশ খুঁজে পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে গেছে। তুরস্কের বিধ্বস্ত প্রদেশগুলোতে যেন পিছু ছাড়ছে না ভূমিকম্পের থাবা।

সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ৪ মিনিটে ৬ দশমিক ৪ এবং ১১টা ৭ মিনিটে ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে হাতায় প্রদেশ কেঁপে ওঠে। এতে মাইলের পর মাইল সড়কের ফাটলগুলো আরও বড় আকার ধারণ করেছে। ফলে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নিরাপদ আশ্রয়, আশ্রয় শিবিরগুলোতে থাকা অসহায় মানুষগুলোর আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সোমবার রাতের ভূমিকম্পে চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহতের সংখ্যা তিন শতাধিক। স্থানীয় সূত্র বলছে, হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপগুলো নতুন ভূমিকম্পের কারণে আরও দেবে গেছে। ফাটলধরা ভবনগুলো দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। উদ্ধারকারী দল ও স্থানীয় সূত্র বলছে, পুনরায় ভূমিকম্পে হতাহত কম হলেও উদ্ধার কাজ মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। হাতায় প্রদেশে ১৭ হাজার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পচাগলিত লাশ একের পর এক উদ্ধার হচ্ছে। দাফনের জন্য সেগুলো কবরস্থানে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কবরগুলোতেও দাফনের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। হাতায় প্রদেশ ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে শত শত ভবন দেবে পড়েছে। বেশ কয়েকজন উদ্ধারকর্মী জানান, বিভিন্ন কৌশলে লাশ বের করছিলাম। সুড়ঙ্গ করে লাশ বের করছিলাম। কিন্তু নতুন করে ভূমিকম্প হওয়ায় এখন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। উদ্ধারকাজে চরম বেগ পেতে হবে। স্তূপ ঘিরে যারা নিখোঁজ মানুষদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নতুন ভূমিকম্প তাদের আশা একেবারে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে হাতায় প্রদেশে দেফনে উপশহরের একটি ধ্বংসস্তূপ ঘিরে বেশ কয়েকজনকে কান্না করতে দেখা যায়। জাইনেপ অজগুভেন নামে এক বৃদ্ধা জানান, পরিবারের নিখোঁজ তিনজনের জন্য ১৩ দিন ধরে অপেক্ষা করছেন। আশায় বুক বেঁধেছিলাম-ধ্বংসস্তূপ থেকে তাদের জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় পাব। এখন দেখছি ধ্বংসস্তূপ আরও দেবে গেছে। উদ্ধারকারী দল জানিয়ে দিয়েছে-জীবিত অথবা মৃত কাউকে আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়।

তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা সংস্থা ‘আফাদ’ জানায়, সোমবারের দুটি ভূমিকম্পে হাতায় প্রদেশ ছাড়াও বাকি নয়টি প্রদেশে আঘাত হেনেছে। গাজি আনতেপ, শানলি উরফা ইয়োলো জোনে থাকলেও বাকি আট প্রদেশকে রেড জোন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গাজি আনতেপে নতুন করে বহু ভবন দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। আবারও ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে বলে সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রদেশগুলোর বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু বাসিন্দা, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা ধ্বংসস্তূপ এলাকায় অবস্থান করছেন। ফলে পদে পদেই ঝুঁকি রয়ে গেছে। খোলা আকাশে তাঁবুতে তাদের বসবাস হলেও আতঙ্ক তাদেরও পিছু ছাড়ছে না। নতুন ভূমিকম্পে সবকিছু যেন এলোমেলে হয়ে গেছে। উদ্ধারকাজে চরম বেগ পেতে হচ্ছে।

জানা গেছে, সোমবারের দুটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল হাতায় প্রদেশের দেফনে উপশহর। ওই সময় সিরিয়া, মিসর এবং লেবাননেও কম্পন অনুভূত হয়। বেশ কয়েকটি আশ্রয় শিবিরের তাঁবুতে গিয়ে জানা যায়, আশ্রয় শিবির এলাকার সমতল ভূমিতেও ফাটল ধরেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তুরস্কের এক পুলিশ সদস্য জানান, তাঁবুর নিচে থাকা মানুষরাও আতঙ্কে রয়েছে। বিশেষ করে শিশুরা প্রায় কেঁদে উঠছে। প্রতিটি আশ্রয় শিবির ঘিরে অস্থায়ী খেলাধুলার জায়গা তৈরি করে দেওয়া হলেও শিশুদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। উপশহরের বেশ কয়েকটি প্রধান সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সড়কজুড়ে থাকা ফাটল এখন গর্তে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ধ্বংসস্তূপের জঞ্জাল সরাতে মাসের পর মাস লেগে যাবে। খাদ্যসামগ্রীসহ ওষুধ, সুপেয় পানি আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। উদ্ধার অভিযানে আরও সময় প্রয়োজন।

এদিকে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলু গণমাধ্যমকে জানান, দ্বিতীয়বার পরপর দুটি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। আনতাকিয়া, দেফনে এবং সামানবায়ে তিনজন মারা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ভবনে প্রবেশ না করতে সাধারণ জনগণকে আহবান করেছেন তিনি।

এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধারকারী দলের অনেকে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। নতুন ভূমিকম্পের সময় বাংলাদেশের উদ্ধারকারী দল হাতায় প্রদেশে ছিল। রাত সোয়া ৩টার দিকে বাংলাদেশের উদ্দেশে তারা যাত্রা করেন। তুরস্ক ত্যাগের আগে টিম লিডার লে. কর্নেল মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, আমরা বহু লাশ উদ্ধার করেছি, ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিতদের বের করেছি। উদ্ধার কাজ শেষে আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু টিমের প্রত্যেক সদস্যের মন এখনো ধ্বংসস্তূপ এলাকায় পড়ে আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন তুরস্কবাসীদের রক্ষা করেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সহায় হবেন।’ এদিকে ভূমিকম্পের পরপর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।।