আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া নজরে বাংলাদেশের নির্বাচন

বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের নতুন হাইকমিশনার সারাহ কুক সম্প্রতি চ্যানেল আই’র জনপ্রিয় অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রাধান্য বৃদ্ধির কারণে নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যথেষ্ট আগ্রহ থাকবে। বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার আগ্রহ থাকবে। সেই সঙ্গে সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের প্রত্যাশাও থাকবে। বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে পারার মানে বাংলাদেশিরা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বেছে নিতে পারবে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের বের হওয়ার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে অধিক বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় সাহায্য করে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৈদেশিক বিনিয়োগ আনতে সাহায্য করে। আগামী ছয় মাসে বাংলাদেশে কী ঘটছে তা নিয়ে প্রচ- আন্তর্জাতিক মনোযোগ থাকবে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানোকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে উৎসাহ যোগাতে আন্তর্জাতিক অংশীদাররা যা করে তার সঙ্গে সংগতি রেখে যুক্তরাজ্য এখানে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত থাকবে।আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাজ্যের এমন অবস্থান অবশ্য নতুন নয়। সারাহ কুকের পূর্বসূরি রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসনও আজ থেকে ১৫ মাস আগে মানবজমিন প্রধান সম্পাদককে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায়। তারা প্রথমেই খুঁজেন সুশাসন। বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। আগামীর নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেছিলেন, মানুষ যাতে অবাধে ভোট দিতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশ করতে পারে- এই বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে বেশি। নির্বাচনের আগে মুক্তভাবে বিতর্ক করার সুযোগ থাকতে হবে। মানুষ যাতে অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়টি আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাই মিলে এটা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিকভাবে ভোট গণনা ও ফল প্রকাশের ওপর জনগণ এবং প্রার্থীদের যেন আস্থা থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তথা তার দেশের অবস্থান অবশ্য পুরোপুরি স্পষ্ট। মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘন ঘন বাংলাদেশে সফর করছেন এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। শুধু আহ্বান বা উদ্বেগ জানানো হয় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপও নিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯ মাস আগে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ কারণে র‍্যাব এবং এর সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনে ১১০টি দেশ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। এ বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ‘গণতন্ত্র সম্মেলনেও বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। মে মাসে তো উল্টো ভিসা নীতি আরোপ করা হয়, যাতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কেউ বাধা দিতে না পারে। 

নির্বাচনের অনেক আগে এই ভিসা নীতি আরোপের ফলে সচেতন মহল মনে করছেন নির্বাচনকে ঘিরে যেন ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হয় সেজন্যই দেশটি এত আগে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য রাষ্ট্রদূত হাস এর আগে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, নির্বাচন কেবল একদিনের বিষয় নয়, আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও নির্বাচন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। নিজের পরিচয়পত্র পেশ করার মাসখানেক পরেই (২৪শে এপ্রিল, ২০২২) তিনি এক সেমিনারে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু নির্বাচনের দিন ভোটদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্যত ইতিমধ্যেই নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আবশ্যক হলো নাগরিকদের মতামত প্রকাশ, সাংবাদিকদের ভয়ভীতি ছাড়া অনুসন্ধান এবং নাগরিক সমাজের ব্যাপক পরিসরে জনমত গঠনের সুযোগ নিশ্চিত করা। পরের মাসেই (৩১শে মে) তিনি বলেছিলেন, আনুষ্ঠানিক না হলেও বাংলাদেশে যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে পত্রিকায় চোখ বুলালেই সেটা দেখতে পাই।

 তাই এখন থেকেই আমাদের দিক থেকে অবাধ, সুষ্ঠু এবং আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন হচ্ছে কিনা সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখাটা জরুরি। ওই বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে পিটার হাস বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যেই (বাংলাদেশের) বর্তমান পরিস্থিতিতে নজর রাখছে’। নির্বাচনের এক বছরেরও অনেক আগে থেকেই যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর নজর রেখে থাকে তাহলে এই মুহূর্তে সেই নজরের পরিধি যে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলাবাহুল্য। অবশ্য চলতি বছরের এপ্রিলে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এ কথা খোলামেলাভাবেই জানিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সেজন্য আমরা তো অবশ্যই, সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যাতে এ অঞ্চল এবং সারা বিশ্বের জন্য একটি জোরালো উদাহরণ তৈরি করএদিকে, বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক বাংলাদেশে আসার পর নির্বাচন নিয়ে যে কথা বলেছেন, দেড় বছর আগে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় ঠিক একই কথা বলেছিলেন পিটার হাসের পূর্বসূরি রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার। এই প্রতিবেদককে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য, পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে সমর্থন করে যা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়’। এরকম একটি নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের আগে থেকেই যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে একথাও সবাই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বলে যাচ্ছেন।