দেশে রপ্তানির বিপরীতে ১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের আয় ফেরত আসেনি। আটকে থাকা রপ্তানি আয়ের মধ্যে অর্ধেকই মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া রপ্তানির আদেশের বিপরীতে কম পণ্য সরবরাহ করা, রপ্তানিকারক-আমদানিকারক দেউলিয়া হওয়া এবং ভুয়া রপ্তানির কারণে আটকে আছে আরও অর্ধেক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জাসূত্র জানায়, ৫ মে পর্যন্ত রপ্তানির বিপরীতে দেশে ১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার ফেরত আসেনি। এর মধ্যে ৭০০ মিলিয়ন মেয়াদোত্তীর্ণ, ২৫৫ মিলিয়ন ডলার আটকে আছে ক্রয়াদেশের তুলনায় কম পণ্য সরবরাহ করার কারণে বিল পরিশোধ না করায়। রপ্তানিকারক-আমদানিকারক দেউলিয়া হওয়ায় ৬৮ মিলিয়ন ডলার আটকে আছে। ভুয়া রপ্তানির কারণে আটকে আছে ১২৫ মিলিয়ন ডলার ও মামলার কারণে ২৫১ মিলিয়ন ডলার।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, একশ্রেণির অসাধু রপ্তানিকারকরা বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনছেন না। তারা পুঁজি পাচারের মাধ্যমে বিদেশে বেগমপাড়ায় অট্টালিকা গড়ে তুলছেন। এটা খুবই অশনিসংকেত। এভাবে চলতে থাকলে ডলার সংকট নিরসন সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সিংহভাগই আদায় হয়। কিছু অর্থ ওভারডিউ বা মেয়াদোত্তীর্ণ থাকে। সেটাও আদায়ের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যেমন গত বছর মোট ওভারডিউ থেকে ২৮১ মিলিয়ন ডলার আদায় হয়েছে। এখন আদায় না হওয়া রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১৪০ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এটাও আদায় হবে। তবে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
একাধিক সংস্থার তথ্যের গরমিল বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে মেজবাউল হক বলেন, যখন অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য দেশে বিক্রি হচ্ছে, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তাদের হিসাবে তা রপ্তানি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এজন্য দেশে কোনো রপ্তানি আয় আসছে না। এই পণ্য যদি আবার বিদেশে রপ্তানি হয়, তাহলেই কেবল রপ্তানি আয় দেশে আসার কথা। এখানেই ১০০ থেকে ২০০ কোটি ডলারের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি আইএমএফ রপ্তানি বিল দেশে না আসার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিদেশে কত অর্থ আটকে রয়েছে, সেগুলো কেন দেশে আনা হচ্ছে না সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, বৈদেশিক মুদ্রার অন্তর্মুখী প্রবাহ কমে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত হারে রেমিট্যান্স আসছে না। রপ্তানি আয়েও তেমন গতি নেই। কিন্তু বিপরীতে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হচ্ছে তার ব্যয় পরিশোধের পাশাপাশি আমদানির বকেয়া দায়ও পরিশোধ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়েই বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহের চেয়ে বহিঃপ্রবাহ বেশি। যার প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২৩ আগস্ট বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুত দুই হাজার ৩১৬ কোটি ডলারে নেমে গেছে। যেখানে জুলাই শেষে ছিল দুই হাজার ৩৩৫ কোটি ডলারে। সে হিসাবে ২৩ দিনে প্রকৃত মজুত কমেছে ১৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রায় প্রতিদিনই কমছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত।
এদিকে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলার বাজারে যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলা করতে দেশীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এতে বেড়ে যায় পণ্যের আমদানি ব্যয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ২৩ আগস্ট প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৯৫ টাকা, এ বছর ২৩ আগস্ট তার জন্য ব্যয় করতে হয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। তবে এ হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাস্তবে এরও বেশি দরে ডলার লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কেনাবেচায় নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা মানছে না। ব্যাংকারদের সংগঠন যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ডলার লেনদেন হচ্ছে তার চেয়েও বেশি দরে। রেমিট্যান্স আহরণ করছে ১১২ টাকা দরে। অথচ নিজেদের সিদ্ধান্ত ছিল ১০৮ টাকা। আর বেশি দরে ডলার আহরণ করায় আমদানির ক্ষেত্রে বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে।
অন্যদিকে ডলার বাজারের অস্থিরতা কমাতে এবং জরুরি পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার সংকট থাকায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টের ২৩ দিনে (১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ১৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
মন্তব্য