ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের একটা কঠিন সময় চলছে। হামাসের হামলার জবাবে ইসরাইল গাজায় গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছেঅল্প জায়গায় সর্বোচ্চ ঘনবসতি থাকা গাজার মানুষদের অন্য প্রান্তে চলে যেতে বলেছে যদিও ফিলিস্তিনিদের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকা তো দূর মৌলিক অধিকারের সুযোগও নেইগাজার দক্ষিণে পরিস্থিতি এতটাই মানবেতর যে অনেকে উত্তরেই ফিরে যাচ্ছেন। পশ্চিম তীরেও আরও আগে থেকেই ইসরাইলের নানা দমন পীড়ন চলছে। গাজা এবং পশ্চিম তীর দুই দিকেই ফিলিস্তিনের মানুষ এখন অনেকটা বন্দীদশায় মানবেতর অবস্থায় রয়েছে।
কিন্তু এই দুই অংশের সঙ্গে যেসব দেশের সীমান্ত, মিসর ও জর্ডান তাদের কেউ এসব মানুষকে ঠাঁই দিতে রাজি না।
এনিয়ে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন জর্ডানে কোনো শরণার্থী নয়, মিসরে কোনো শরণার্থী নয়। এই মানবিক সংকট গাজা এবং পশ্চিম তীরের ভেতরেই সামাল দিতে হবে। এবং ফিলিস্তিনি সংকট ও তাদের ভবিষ্যৎ অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া বা চেষ্টা করা যাবে না।
কেন প্রতিবেশী দেশগুলো নিজ দেশে ফিলিস্তিনের মানবেতর অবস্থায় থাকা মানুষদের আশ্রয় দিতে চায় না?
ফিলিস্তিনের গাজা অংশের সাথে ইসরাইল ছাড়া সীমান্ত রয়েছে শুধু মিসরের। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিও জর্ডানের বাদশাহর মতো একইভাবে ফিলিস্তিনিদের নিজ দেশে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানের জন্য কোনো সামরিক উপায়ে বা ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে যে কোন পদক্ষেপ মিসর প্রত্যাখ্যান করে যেটা এ অঞ্চলে দেশগুলোর ক্ষতি সাধন করতে পারে।
একই সাথে তিনি এও বলেন যে গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে মিশরের দিকে পাঠানোর চিন্তা করার আরেক অর্থ “পশ্চিম তীরের মানুষদের বাস্তুচ্যুত করে জর্ডানে পাঠানোর মতো একই ধরণের পরিস্থিতি ঘটবে” এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য মিশর বা আন্তর্জাতিক মহলে যে আলোচনা চলছে সেটা আর সম্ভব হবে না।
১৯৭৮ সালে মিসরই ছিল প্রথম কোনো আরব রাষ্ট্র যারা কয়েক দফা যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের সাথে সমঝোতায় আসে।
২০০৭ সালে হামাস গোষ্ঠী গাজার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসরাইলের সঙ্গে সঙ্গে মিসরও গাজার সাথে তাদের সীমান্তের কড়াকড়ি বাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, হামাস যাতে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে মিসরে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্যেই এতটা কড়াকড়ি। কারণ বাড়তি সশস্ত্র গোষ্ঠী তৎপরতা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা মিসরের নেই।
হামাস আশির দশকে সৃষ্টি হয়েছিল মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা হিসেবে। মুসলিম ব্রাদারহুড ২০১১ সালে মিসরের ক্ষমতায় আসলেও এখন তাদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে হামাসের শেকড়ের সম্পর্কটাও একটা উদ্বেগের বিষয়।
মিসরের বর্তমান সরকারের সাথে হামাসের সম্পর্ক রয়েছে। একটা সময়ে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমও ছিল তারা।তবে নিজ দেশে শরণার্থীর ঢল চায় না মিসর। সেটা দিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য মিসরকে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে যেটা স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
মিসরের প্রেসিডেন্ট গাজার উদ্বাস্তুদের গাজার কাছে ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমিতে রাখার পরামর্শ দেন যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরাইলের অভিযান শেষ না হচ্ছে।
মিসরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীর কোনো সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। ধারণা করা হয় সংখ্যাটা ৫০ হাজার থেকে এক লাখের মতো হতে পারে।
জাতিসংঘের হিসেবে মিসরে সাড়ে তিন লাখের উপরে নিবন্ধিত শরণার্থী আছে যাদের দেড় লাখই এসেছে সিরিয়া থেকে।
তাই মিসরের শঙ্কা একবার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী তাদের দেশে ঢুকলে তাদেরকে আর তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডে ফেরানো সম্ভব হবে না।
এসব কিছুর পাশাপাশি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট যতটাই হোক প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে নিজেদের স্বার্থের দিকটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তুরস্কের হাসান কালিয়ানচু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. মুরাত আসলান।
তিনি মিসরের সঙ্গে ইসরাইলের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বিবিসিকে বলেন, ইসরাইলের প্রাকৃতিক গ্যাস মিসরের রিফাইনারিগুলোতে তরলীকরণ হয় যেটা পুরো বিশ্বে বাজারজাত করা হয়।নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটে সেটা বাড়ার সম্ভাবনাও থাকে। মিশর সবসময়ই ইসরাইলের নীতিমালার সাথে জোটবদ্ধ।
অন্যদিকে জর্ডানের সাথে ফিলিস্তিনের সীমান্ত পশ্চিম তীরের দিকে। মিসরের মতো জর্ডানেরও রয়েছে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। যেমন গ্যাস তো বটেই, সুপেয় পানির জন্যও ইসরাইলের উপর নির্ভর করতে হয় জর্ডানের।
ড. মুরাত আসলানের মতে জর্ডান সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সৌদি আরব, ইসরাইল ও আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। জর্ডান আমেরিকার মিত্র দেশ, এছাড়া আমেরিকা ও জার্মানির বিমান সেখানে অবস্থান নিয়ে আছে, এমন অবস্থায় ফিলিস্তিন বিষয়ে জর্ডান অনেকটা নিশ্চুপ থাকতে পছন্দ করবে।
সবশেষ গাজায় হাসপাতালে হামলার প্রেক্ষাপটে অবশ্য জর্ডানসহ ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের সরকার এবং মিসর আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক বাতিল করেছে। আরব দেশগুলোকে মানবিক সংকটের বিষয়ে একজোটও মনে হচ্ছে। কিন্তু সরাসরি শত্রুতা বা যুদ্ধে গড়ানোর পর্যায়েও কেউ যেতে চায় না।
ফিলিস্তিনের সাথে সীমান্ত না থাকলেও ইসরাইলের সাথে সীমান্ত থাকা লেবাননও এবারের সংকটে একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেছে।
বর্তমানে লেবাননের হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সাথেও ইসরাইলের সীমান্তে প্রায় যুদ্ধাবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হেজবুল্লাহ কী করবে তার প্রভাব লেবাননেও পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
লেবাননেও বড় সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে সংখ্যাটি প্রায় চার লাখ ৯০ হাজার। এমনিতেই লেবানন নানা অর্থনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত অবস্থায় আছে।
অভ্যন্তরীণ নানা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দেশটিতে এখন কোনো কার্যকর সরকার বা প্রেসিডেন্ট নেই। রয়েছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়েও উদ্বেগ।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে লেবাননের ক্ষয়ক্ষতি হলে অথবা সেখানে কোনোভাবে ফিলিস্তিনি শরণার্থী স্থানান্তর করা হলে সেটা সামাল দেয়ার পরিস্থিতি লেবাননের নেই।
এসব নানা সংকট মিলেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ হলেও তারা বড়জোর নিন্দা জানাতে পারে বলে মনে করেন ড. মুরাত আসলান।
তার মতে, প্রতিবেশী দেশগুলো কোনো পক্ষের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না এবং তাদের মনোযোগ নিজেদের লাভের দিকেই। তাই ফিলিস্তিনের ইস্যু শুধু ফিলিস্তিনের, অন্যদের না।।।
মন্তব্য