বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমর ও প্রিন্স রিমান্ডে

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় বাস পোড়ানোর মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের চার দিন এবং মহাসমাবেশের দিন পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ভাঙচুর ও অস্ত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এছাড়া প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীসহ ৫১ জনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। রোববার পৃথক আদালত তাদের রিমান্ড ও কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এছাড়া রিমান্ড শেষে মির্জা আব্বাসকে কারাগারে পাঠবিএনপি ও জামায়াতের দাবি-২৮ অক্টোবর সমাবেশের আগে ও পরে ১২ দিনে সারা দেশে তাদের ৬ হাজার ৯২৯ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৩৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে আদালতে শুনানির সময় অনুমতি নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মেজর (অব.) শাহজাহান ওমর বলেন, ‘আমি তো ক্রিমিনাল (অপরাধী) নই। আমি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী। আমার বয়স ৭৪। এ বয়সে আমাকে পুলিশ রিমান্ডে চায়। ছেলের বয়সিরা আমাকে রিমান্ডে নিয়ে মানসিকভাবে হেনস্তা করতে চায়। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমি কি এ পরিস্থিতিতে দাঁড়ানোর জন্য যুদ্ধ করেছি? আমি নিজেই আমার জামিনদার হতে চাই। আপনি যে শর্ত দেবেন তা মেনে নেব। আমি জামিন চাই।’ শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, এজাহারে শাহজাহান ওমরের নাম নেই। সন্দেহভাজন হিসাবে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মতো লজ্জাজনক আর কী হতে পারে। তাকে কেন রিমান্ডে নিতে হবে।

রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনের মামলায় রিমান্ড শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। রোববার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক নুরুল ইসলাম। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ২০০৭ সালের ১৬ আগস্ট সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক মামলা করে। সে মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এদিন মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য ছিল। ৮ নভেম্বর নতুন দিন ধার্য করা হয়েছে।

শুনানির এক পর্যায়ে মির্জা আব্বাস বলেন, এর আগেরবার মির্জা ফখরুল ও আমাকে গ্রেফতার করে ফাঁসির সেলে রাখা হয়েছিল। এবার আমাকে ফ্লোরে রাখা হচ্ছে। এবার তো হেঁটে আসছি। এর পরেরবার হয়তো হুইল চেয়ারে আমাকে আসতে হবে। তখন বিচারক বলেন, আমরা তো হাইকোর্টের মতো সরাসরি আদেশ দিতে পারি না। আবেদন করেছেন তা আমি দেখব। কারাগারে আব্বাসের ডিভিশন ও চিকৎসার আবেদন করেন তার আইনজীবী। আদালত কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন ও সুচিকিৎসার দেওয়ার নির্দেশ দেন।

রোববার ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন-মহাসমাবেশের ৩ থেকে ৪ দিন আগে থেকে এখন পর্যন্ত ১২২টির বেশি মামলায় ৫ হাজার ২৮৪ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় ১০ জনের (এক সাংবাদিকসহ) মৃত্যু হয়েছে। ৩ হাজার ৪৯৮ জনের বেশি নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এছাড়া শনিবার রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ২৬১ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নতুন করে ৯টি মামলায় এক হাজার ৬০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। রিজভী আরও বলেন, শনিবার গভীর রাতে শাহজাহান ওমর ও রোববার ভোরে আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবিরা সুলতানা মুন্নিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

রিজভী অভিযোগ করেন, বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দীন আহমেদ অসিমের ধানমন্ডির বাসায় শনিবার রাত ২টার দিকে প্রবেশ করে ডিবি পুলিশ। তাকে না পেয়ে তার বাসার স্টাফদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনার শ্বশুরবাড়িতে গভীর রাতে তল্লাশির নামে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে।

রোববার জামায়াতের মিডিয়া শাখা থেকে জানানো হয়-২৫ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪৫ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার বিকাল থেকে রোববার বিকাল পর্যন্ত ৮৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন জানান, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতা, নাশকতা, পুলিশকে মারধর, পুলিশ সদস্য হত্যা ও অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ৮৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শনিবার পর্যন্ত আট দিনে ১ হাজার ৫০২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ডিএমপির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী-শনিবার রাজধানী থেকে ৩৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া ২১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ১৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ওয়ারী বিভাগ সর্বোচ্চ ৫২৫ জনকে গ্রেফতার করে। এরপর মিরপুর বিভাগ ৪৯২ জনকে গ্রেফতার করে। পল্টন থানায় আট দিনে সবচেয়ে বেশি ১৪টি মামলা হয়েছে। এরপর রমনা মডেল থানা ও শাহজাহানপুর থানায় ছয়টি করে মামলা করা হয়।

রোববার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মহাসমাবেশের দিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অরাজকতা ও নাশকতা হয়েছে। হরতাল-অবরোধেও নানা জায়গায় সহিংসতা চলছে। এসব সহিংসতায় যারা জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, ২৮ অক্টোবর শান্তিনগরে পুলিশের গাড়ি এবং মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ দুটি ঘটনায় রমনা থানা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মহিউদ্দিন হৃদয় এবং আহ্বায়ক আমিন মাহিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতাররা জানিয়েছে, তারা ঢাকা মহানগর যুবদল দক্ষিণের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের নির্দেশে অগ্নিসংযোগ এবং নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েছেন।

ঢাকার ডিবি প্রধান বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় যুবদলের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক সাইদুল হাসান মিন্টুর নির্দেশে অপর একটি গ্রুপ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে লিপ্ত। তারা বোমা তৈরির কারখানাও করেছে। ইতোমধ্যে ওই কারখানায় অভিযান চালিয়ে মিন্টুসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য দুজন হলেন-২৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সহসভাপতি বাশার ও চকবাজার থানা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মাসুদ। শুক্রবার রাতে গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে আট কেজি গানপাউডার ও ২১টি হাতবোমা উদ্ধার করা হয়। হরতাল ও অবরোধে মিন্টুর দায়িত্ব ছিল পুরান ঢাকা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশের এলাকায় ককটেল নিক্ষেপ করা। ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশস্থলে অনেক বোমা বিস্ফোরণ করা হয়েছে। এর দায়িত্বে ছিলেন মিন্টুসহ যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাজধানীর এক অংশে হৃদয় ও মাহিন এবং অপর অংশে মিন্টু, বাশার ও মাসুদ আগুন লাগাত, বোমা নিক্ষেপ করত। এ দুই অংশের নির্দেশদাতা হলেন সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। অগ্নিসন্ত্রাস এবং নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে টুকুসহ অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা হবে। জনগণের জানমাল এবং সরকারি সম্পত্তি নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তাদের নাম পাওয়া গেছে। দেশের যেখানেই তারা থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, রোববার উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনায় গাজীপুর মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি জিএম হাসানকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে।

এদিকে রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে রাজধানীর টঙ্গী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, নাশকতা ও সহিংসতার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি।

র‌্যাব আরও জানায়, সম্প্রতি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হামলা ও নাশকতার ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।