রাইদা পরিবহণের একটি বাসে রাজধানীর কুড়িলের দিকে আসছিলেন রামপুরার বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিল। বাসটি শাহজাদপুর আসার পর হঠাৎ করেই পেছনের কয়েক যাত্রী ‘আগুন-আগুন’ বলে চিৎকার করে নেমে যান। আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করে বাসের অন্য যাত্রীরাও যে যেভাবে পারেন নামতে থাকেন। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে পুরো বাসটি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে বলে জানান খলিল। বৃহস্পতিবার দুপুরের এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি মামলা হয়। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজও আসে পুলিশের হাতে। পুলিশের ভাষ্য, তারা অগ্নিসংযোগের সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছেন। তবে নাশকতাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে এমন ৭৪টি বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের চতুর্থ দফায় ৪৮ ঘণ্টা অবরোধ শুরুর আগের দিন শনিবার রাতেই ঢাকায় ৮টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। যেন হরতাল-অবরোধে নাশকতাকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে যাত্রীবাহী বাস। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা যে কোনো সময় বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণহানিও হচ্ছে। পুলিশের টহল ও স্থাপনার কাছাকাছি স্থানেও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। প্রতিটি আগুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। অধিকাংশ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজও হাতে পেয়েছে পুলিশ। তবে সব ঘটনায় মাত্র ১২ জন হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছেন। এদের কয়েকজনকে আবার উপস্থিত জনতা আটক করেছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জনমনে স্বস্তি ফেরাতে কেন অগ্নিসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের মনে। এমন পরিস্থিতিতে আগুনের ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কৌশলী পদক্ষেপের কথা জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিসন্ত্রাসীদের রুখতে পুরোনো পদক্ষেপের পাশাপাশি নতুন কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। মূলত অগ্নিসংযোগকারীরা ছদ্মবেশে-যাত্রীবেশে চোরাগোপ্তা কাজগুলো করছে। তারা পুলিশের গতিবিধি নজরে রেখে ফাঁকা জায়গায় ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। এ কারণে বিষয়টি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে।
অনেক ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আছে তবুও অপরাধীরা ধরা পড়ছে না কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিছু ধরা পড়ছে। চোরাগোপ্তা ঘটনার জন্য অনেককে ধরা যায়নি। আসলে আমাদের কাজ তো অনেক। আগুন প্রতিরোধ, অপরাধী শনাক্ত, আইনি প্রক্রিয়া- সব কাজই করতে হয়। সিসিটিভি ফুটেজ সব জায়গার নেই। কিছু কিছু জায়গায় নাশকতাকারীরা সিসিটিভি নষ্ট করে ফেলেছে। যেগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের ধরতে কাজ চলছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রতিদিন সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার বাস চলাচল করে। এগুলোর নিরাপত্তা দিতে আজ থেকে পুলিশের ‘ডেডিকেটেড টিম’ কাজ করবে। বাসে আগুন জ্বালিয়ে নাশকতা রুখতে রাজধানীর ৫০টি থানায় ৮ হাজারের মতো পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। আরও ৫ হাজার সদস্য মাঠপর্যায়ে সরাসরি কাজ করছেন। এই ১৩ হাজার পুলিশ সদস্যকে নানা কৌশলে কাজে লাগানো হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ সময় চিহ্নিত করছেন। এর থেকে তারা জেনেছেন, অগ্নিসংযোগকারীদের মধ্যে কেউ যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠে বা নিচে থেকে অগ্নিসংযোগ করছেন। এজন্য তারা পেট্রোল, গান পাউডার, দিয়াশলাই, তুলা, পুরোনো কাপড় ব্যবহার করছেন। সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি বিধায় এই সময়টি নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করা হয়েছে। খালি বাস আগুন সন্ত্রাসীদের টার্গেটের কেন্দ্রে থাকায় বিষয়টি নিয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে বসে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাস যাত্রীদের অনুরোধ করা হয়েছে পেছনের সিটগুলো খালি থাকলে সামনের দিকে এসে বসার জন্য। সম্ভব হলে পেছনের দিকে যেন বাসের পক্ষ থেকে একজন লোক রাখা হয়। এতে যাত্রীবেশে নাশকতার ঘটনাগুলো অনেকটাই ঠেকানো যাবে।
ঢাকার বিভিন্ন থানা এলাকার পুলিশ সদস্য ও স্থানীয়দের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় । তারা বলছেন, প্রধানত চারটি কারণে বাসে অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রথমটি হলো- বিভিন্ন সড়কে সিসিটিভি থাকলেও এর অধিকাংশই নষ্ট। দ্বিতীয়ত, যাত্রীবেশে উঠে বাসের ভেতরে অগ্নিসংযোগ করায় প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, যেসব এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো ঘটছে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সম্ভাব্য অপরাধীদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েও তারা চেহারাগুলো চিহ্নিত করতে পারছেন না। এর থেকে ধারণা করা যায়, এক এলাকার অপরাধীরা অন্য স্থানে গিয়ে অগ্নিসন্ত্রাস করছেন। চতুর্থত, দায়িত্ব পালনকালে অনেক পুলিশ সদস্য বসে খোশগল্প করেন, বেখেয়ালি থাকেন এবং মোবাইলে লুডু খেলাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। ফলে অপরাধীরা দ্রুত গাড়িতে আগুন দিয়ে পালাতে পারছে।
শাহজাদপুরে বাসে আগুন লাগার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইব্রাহিম খলিল বলেন, রামপুরা থেকে উঠে বাসের দ্বিতীয় সারির সিটে বসেছিলাম। সুবাস্তু এলাকা পার হওয়ার পর পেছন থেকে কয়েকজন যাত্রী ‘গাড়ি থামান, থামান’ বলে গেটের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। অন্য যাত্রীরা ভেবেছিল তাদের স্টপেজ পার হয়ে যাওয়ায় তারা বাসটি থামাতে বলছিলেন। ড্রাইভার গাড়িটি থামালে তিন-চারজন যুবকের ওই দলটি ‘আগুন-আগুন’ বলে চিৎকার করে। এরপর তারা নেমে যায়। তখন বাসের পেছনের আগুন দৃশ্যমান হয়। যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নামতে থাকেন। বাসটিতে কয়েকজন নারীসহ ১৫-১৬ জন যাত্রী ছিলেন। আতঙ্কের মধ্যে নামার সময় পড়ে গিয়ে কয়েকজন আহত হন। এরপর ফায়ার সার্ভিস আসে। ততক্ষণে বাসটি পুড়ে যায়। এর মধ্যে পুলিশও ঘটনাস্থলে হাজির হয়। ততক্ষণে পেছন থেকে আসা তিন-চারজন বাস থেকে নেমে সটকে পড়েন।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো প্রতিরোধে তারা কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাসে উঠে পুলিশ সদস্যরা যাত্রীদের ছবি তুলে রাখছেন। যাতে করে বাসটিতে নাশকতার ঘটনা ঘটলে যাত্রীদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়। বাস মালিকদের সঙ্গেও তারা বৈঠক করছেন। ছবি তুলে রাখার বিষয়ে বাস স্টাফদেরও তারা উৎসাহিত করছেন। কোনো কোনো বাসে পুলিশ সদস্যরা যাত্রীবেশে উঠে অবস্থান করছেন। সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করছেন। এছাড়া অতীতে যারা অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িয়েছেন তাদের ওপরেও নজরদারি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা বলেন, খালি বাস ও থেমে থাকা বাসগুলো অগ্নিসংযোগকারীরা বেশি টার্গেট করছে। আগুনের ঘটনার কিছু সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেলেও তা স্পষ্ট নয়। ফলে চেহারা শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা দায়িত্বাধীন এলাকায় ২৪ ঘণ্টা টহল নিশ্চিত করছি। গাড়িতে হুটার বাজিয়ে এবং হুটার ছাড়া টহল টিম কাজ করছে। পাশাপাশি মোটরসাইকেল প্যাট্রোলিং ও ফুট প্যাট্রোলিং চলছে। সাধারণ মানুষের চলাচল নিরাপদ রাখতে আমরা সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
থানাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা এ কৌশলগুলোর পাশাপাশি নিজের এলাকাকে নিরাপদ রাখতে নিজস্ব কিছু কৌশল অবলম্বন করছেন। এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিন যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিভিন্ন স্থানে ‘সারপ্রাইজ চেকপোস্ট’ চালু করেছি। প্যাট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীদের সচেতন করতে কাজ করছি। এসবের পাশাপাশি আমাদের সোর্সদের কাজে লাগাচ্ছি।
মন্তব্য