বিএনপি নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মামলার রায়ে রীতিমতো সাজার জালে আটকা পড়ছেন। পুলিশের ওপর হামলা, কর্তব্য কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার অভিযোগে দলটির কেন্দ্রসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাজা দিয়েছেন আদালত। বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্মমহাসচিব একজন, সম্পাদক ও সহসম্পাদক চারজন, নির্বাহী কমিটির সদস্য তিনজন, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং জেলা পর্যায়ের কয়েকজন সিনিযআদালত সূত্রে জানা যায়, তিন মাসে ২৬ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে ৪১১ জনের সাজা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি নভেম্বরেই পৃথক ২০ মামলায় সাজা হয়েছে ২৭৪ নেতাকর্মীর। মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করার জন্য কখনো রাতেও চলে আদালতের কার্যক্রম।
বিএনপির আইনজীবীরা জানান, বিচারকাজ এত দ্রুত চলছে যে, নির্বাচনের আগে আরও অন্তত ৫০টি মামলার রায় হতে পারে। এসব মামলায় আসামির তালিকায় দলটির ভাইস চেয়ারম্যান থেকে কর্মী পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। এর পাশাপাশি ঢাকার আদালতে বিচারাধীন রয়েছে আরও প্রায় ৫০০ মামলা।
দলকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখতে একের পর এক সাজার ঘটনাকে সরকারের নয়া কৌশল হিসাবে বর্ণনা করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাজাপ্রাপ্তরা যেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। এসব রায়কে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীরা নতুন করে দুশ্চিন্তায়ও পড়েছেন।
সংবিধান অনুযায়ী কেউ কোনো মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের ‘দণ্ডপ্রাপ্ত’ হলে এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ‘অযোগ্য’ হন। দলের শীর্ষ আইনজীবীরা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখতে এবং আন্দোলন দমনের কৌশল হিসাবে তড়িঘড়ি করে এ পন্থা নিয়েছে সরকার। তবে সরকারপক্ষের আইনজীবীরা বিরোধীদের এ অভিযোগ মানতে নারাজ। তারা বলছেন, সাজা নিয়ে বিএনপি যেসব কথা বলছে, তা মনগড়া। স্বাভাবিক নিয়মেই মামলার বিচারকাজ চলছে, তাড়াহুড়া হচ্ছে না।’
আদালত সূত্রে জানা যায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব (৪ বছরের সাজা), ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান (৪ বছরের সাজা) যুগ্মমহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল (২ মামলায় সাড়ে ৩ বছর), তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল (২ মামলায় সাড়ে ৩ বছর), স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু (দেড় বছর), গ্রাম সরকারবিষয়ক সহসম্পাদক বেলাল আহমেদ (৪ বছরের সাজা), সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম (৪ বছরের সাজা), নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম (আড়াই বছরের সাজা), হাবিবুর রশিদ (২ বছরের সাজা), আকরামুল হাসান (২ বছরের সাজা), যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব (২ মামলায় সাড়ে ৪ বছরের সাজা), যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু (২ বছরের সাজা), স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান (২ বছরের সাজা), যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান (৩ বছরের সাজা), সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার (একাধিক মামলায় সাজা), রংপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আনিসুর রহমান লাকু (১০ বছরের সাজা) ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন (১০ বছরের সাজা), রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদসহ যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের একের পর এক সাজা দেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো সরকার যেন নির্বিঘ্নে তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পারে। সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার বিএনপির নেতাদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চাইছে-মন্তব্য করেন তিনি।
বলেন, সরকার দমন-পীড়নের অংশ হিসাবে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে সাজার ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে আদালত আসামিদের সাজা দিয়েছেন। রায় নিয়ে যদি তাদের কোনো অভিযোগ থাকে, তাহলে তারা উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, রাজধানীতে নাশকতার অভিযোগে পৃথক ৭ মামলায় সোমবার ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ১৪০ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের অক্টোবরে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানার মামলায় বিএনপির যুগ্মমহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ ২৫ জনের দুই বছরের সাজার আদেশ দেন আদালত। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির হরতাল-অবরোধ চলাকালে নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার মামলায় বিএনপির যুগ্মমহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ ১৪ জনকে দেড় বছর করে সাজা দেন আদালত।
২০১৩ সালে রাজধানীর তেজগাঁও থানার নাশকতার মামলায় যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবসহ বিএনপির সাত কর্মীকে ২ বছর ৬ মাসের সাজা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বংশালে পুলিশের ওপর হামলার মামলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৬২ নেতাকর্মীকে সাড়ে ৩ বছরের সাজা দেন আদালত।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে চকবাজার থানার একটি মামলায় বিএনপির ১৫ জন নেতাকর্মীকে ২ বছর ৩ মাসের সাজা দেন আদালত। এর আগের দিন রোববার রংপুরে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আনিসুর রহমান লাকু, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, জেলা যুবদলের সহসভাপতি তারেক হাসান সোহাগ, মহানগর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জহির আলম নয়নকে দশ বছরের সাজা দেওয়া হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, তিন মাসে পৃথক ২৬ মামলায় বিএনপির ৪১১ নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ মামলাগুলো ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দায়ের করা হয়েছিল।
এদিকে নির্বাচনের আগে আরও অন্তত ৫০টি মামলায় রায় হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেসব মামলায় আসামির তালিকায় বিএনপি মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেসবাহ যুগান্তরকে বলেন, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০০ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে আরও প্রায় ৫০ মামলা রায়ের পর্যায়ে রয়েছে। এসব মামলায় এক হাজারেরও বেশি আসামি। এর কোনোটি সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ পর্যায়ে। কোনোটি আত্মপক্ষ সমর্থন পর্যায়ে। এসব মামলার বিচার শুনানি শেষ হলেই রায়ের দিন পড়বে।
ওই আইনজীবী আরও বলেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যান্টনমেন্ট থানার নাশকতার এক মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনের তারিখ রয়েছে ২২ নভেম্বর। আত্মপক্ষ সমর্থন শেষ হলেই রায়ের তারিখ পড়তে পারে।
এছাড়াও ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে গাড়ি পোড়ানোর এক মামলার সাক্ষ্যও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলায় বিএনপির উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবও রয়েছেন। এ মামলায়ও রায় হয়ে যাবে শিগগিরই। এসব মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পর্যায় থেকে শুরু করে কর্মী পর্যায়ের নেতাকর্মী রয়েছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে চার বছর আগে মারা যাওয়া ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতাকে ২০ নভেম্বর দেড় বছরের সাজার আদেশ দেন আদালত। তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেন আদালত। মৃত ব্যক্তিকে সাজা দেওয়ায় তার পরিবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার আইনজীবীও। তবে মামলার নথিতে তার মৃত্যুর সংবাদ সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা প্রতিবেদন নেই।
সাজাপ্রাপ্ত মৃত বিএনপি নেতার নাম মো. আবু তাহের দাইয়া। তিনি নিউমার্কেট থানার ১৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। চার বছর আগে নিউমার্কেট এলাকায় মাথা ঘুরে পড়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। সোমবার ঢাকার সিএমএম আদালতের রায়ে তাকেও দণ্ড দেওয়া হয়। সাজার পাশাপাশি মৃত তাহেরকে সাত হাজার টাকা জরিমানার আদেশও দেন আদালত। জরিমানা অনাদায়ে তাকে আরও তিন মাসের কারাভোগ করতে হবে।
এ বিষয়ে মৃত তাহেরের ছেলে এহসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার বাবা রাজনীতি করতেন। রাজনীতি করতে গিয়ে মাথায় অনেক আঘাত লাগে। আঘাত লাগার কারণে তার একটি ক্ষতের মতো হয়েছিল। চার বছর আগে নিউমার্কেট এলাকায় মাথা ঘুরে পড়ে যান। এতে তার মাথায় ক্ষতটি ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান। মৃত বাবাকে আদালত সাজা দিয়েছেন। একজন মৃত ব্যক্তিকে কীভাবে আদালত সাজা দেন, আমার জানা নেই। এটা আমাদের মর্মাহত করেছে।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী জাকির হোসেন জুয়েল বলেন, একজন মৃত ব্যক্তিকে আদালত কীভাবে সাজা দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, চার বছর আগে মারা যাওয়া বিএনপি নেতা আবু তাহের দাইয়া, ১০ বছর আগে গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমন এবং ৮ বছর আগে গুম হওয়া আমিনুল ইসলামকেও কারাদণ্ড দেন আদালত। এ ধরনের রায় শুধু বিচারের নামে অবিচার বা প্রহসনই নয়, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনও।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) শহিদ উদ্দিন বলেন, এ মামলার আসামি আবু তাহের সূচনা থেকে পলাতক। তার অনুপস্থিতিতে এ মামলার বিচার শুরু হয়। তিনি মারা গেছেন কি না, এ বিষয়ে আদালতের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। কোনো আইনজীবী বা তাহেরের পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুর বিষয়ে আদালতকে অবগত করেনি। আদালতকে এ বিষয়ে জানানো উচিত ছিল। মামলার নথি অনুযায়ী আদালত বিচার করে থাকেন। আইনানুযায়ী কেউ মারা গেলে সাজার দায় থেকে স্বাভাবিকভাবেই অব্যাহতি লাভ করবে।
রায় বাতিলের দাবি : এদিকে মৃত ও গুম ব্যক্তিদের পাশাপাশি ‘মিথ্যা’ মামলায় সাজা প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারিক ক্ষমতা থেকে অব্যাহতিসহ সব সাজার রায় বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম।
মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির দক্ষিণ হলে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এ দাবি জানান। তিনি বলেন, আইনজীবী হিসাবে সাজা দেওয়া প্রতিটি মামলা পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, সাজাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের সংশ্লিষ্টতা নেই।
সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমে কোনো ফৌজদারি অপরাধ প্রমাণ করতে হয়। অধিকাংশ মামলায় সাক্ষী হিসাবে শুধু পুলিশ সদস্যকে হাজির করিয়ে সাজা দেওয়া হয়েছে। কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি। এমনকি ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত বিচারিক স্তরগুলোও অনুসরণ করা হয়নি। ফলে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই তড়িঘড়ি করে বিএনপি নেতাদের সাজা দেওয়া হয়েছে।
়র নেতা।
মন্তব্য