সিলেটের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র যেনো 'টর্চার সেল'

নন্দিত ডেস্ক:কখনো দেয়ালের সাথে চেপে মারধর করা হয়। কখনোবা মারধর করা হয় ফ্লোরে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে, আবার কখনো সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়েও মারধর করা হয়। কোনো টর্চার সেলের বর্ণনা নয় এটি। মাদকাসক্তি নিরাময়ের নামে এমন অত্যাচারের অভিযোগ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র বা রিহ্যাব সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে। অথচ তারা সুস্থ করে তোলার নামে অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন। তবে অভিভাবক যখন দেখা করতে আসেন ঠিকই তাদের সামনে সাজিয়ে গুজিয়ে হাজির করা হয়। সুমন মিয়া (ছদ্মনাম) বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। গাঁজার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। হাতে টাকা থাকলে নেশা করতেন। নইলে না। হঠাৎ একদিন নিজ এলাকা থেকে তাকে কয়েকজন যুবক অপহরণ করে। একটি মাইক্রোবাসে করে ঘণ্টাখানেক যাত্রার পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন উপশহরস্থ একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। জানলেন পারিবারিক সম্মতিতেই তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছে। এরপরের গল্প বলতে শিউরে উঠেন সুমন। নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়ার চিকিৎসার নামে চলতে থাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ১১২ দিন পর তাকে ছাড়া হলো। ততদিনে তার জীবন পাল্টে গেছে, হতাশার গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত এক জীবন শুরু হয় তার। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো রিহ্যাব সেন্টার নামেই বেশি। রিহ্যাব শব্দটি ইংরেজি রিহ্যাবিলেশন শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। যার অর্থ মাদকাসক্ত পুনর্বাসন। সে হিসেবে মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে একটি রিহ্যাব সেন্টারের কাজ। তবে রিহ্যাব সেন্টার থেকে ফিরে কতজন সুস্থ জীবনে ফিরে আসেন সেটা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে। রিহ্যাব সেন্টার ঘুরে আসা মাদকাসক্তদের সাথে আলাপে সেটা ভালোই টের পাওয়া গেছে। সুমন আহমদ এবং মাদকাসক্তি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ছিলেন এমন কয়েকজনের সাথে আলাপে জানা যায়, সিলেটের রিহ্যাব সেন্টারগুলোতে চিকিৎসার কথা বলে সহজসরল অভিভাবকদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। জানা গেছে, মাদকাসক্তকে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অভিভাকদের চেয়ে নিরাময় কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্টদেরই আগ্রহ বেশি। রিহ্যাব সেন্টারের মালিক ও দালালরা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে অভিভাবকদের ‘চিকিৎসা’র কথা বলে প্রভাবিত করে মাদকাসক্তদের ভর্তি করতে রাজি করান। মাদকাসক্ত ব্যক্তি সুস্থ জীবনে ফিরে আসবেন এমন আশাতেই অভিভাবকরা পরিবারের সদস্যকে রিহ্যাব সেন্টারে পাঠাতে রাজি হন। চুক্তি করেন রিহ্যাব সেন্টারের সাথে। চুক্তিতে এমন কথাও উল্লেখ থাকে যে, দেশের যেকোনো জায়গা থেকে উল্লিখিত মাদকাসকক্তকে তারা ধরে নিতে পারবেন। আরো উল্লেখ থাকে, সেন্টারে থাকা অবস্থায় আসক্ত বা মাদকাসক্তের মৃত্যু হলে এর দায় সেন্টার কর্তৃপক্ষ নিবেন না। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই সেন্টার মালিক ও কর্মীরা বেরিয়ে পড়েন। তারা মাদকাসক্তকে ধরে সেন্টারে নিয়ে আসেন। যেমনটি নিয়ে আসা হয়েছিলো গোলাপগঞ্জের সুমন মিয়াকে। সরকারি হিসেবে সিলেট বিভাগে ১০টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলাতেই রয়েছে ৭টি। সিলেটের ৭ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র হচ্ছে- আহবান মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র, প্রতিশ্রুতি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, বাঁধন মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র, প্রত্যাশা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, প্রেরণা মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র, এইম ইন লাইফ মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, নিউ প্রশান্তি মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। প্রায় প্রতিটি সেন্টারে ঝুলানো আছে বড়বড় মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাইনবোর্ড। যা দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয় অভিভাবকদের। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সেন্টারে নিয়ে আসার পরপরই শুরু হয় নির্যাতন। শারীরিক ও মানসিক-দুইভাবেই নির্যাতন চলে। ভুক্তভোগীরা জানান, রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তির পর একজন মাদকাসক্তকে কখনো দোষে, কখনো বিনা দোষে শাস্তি পেতে হয়। আর শাস্তিগুলো হয় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বা ফ্লোরে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে মারধর করা হয় তাদের। শাস্তি হিসেবে রাতে ঘুমাতে না দিয়ে কাজ করানো বা বসিয়ে রাখা হয়। সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে মারধর করারও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। তবে অভিভাবকরা কিন্তু ভেতরের এ গল্প জানতে পারেন না। কারণ ভেতরে থাকা ‘চিকিৎসা গ্রহণকারী’কে ভয় দেখানো হয় তারা যদি কিছু বলেন তবে শাস্তির মাত্রা আরো বাড়বে। অভিভাবকরা যখন দেখা করতে যান তাদের সামনে সাজিয়ে গুজিয়েই উপস্থাপন করা হয় মাদকাসক্ত ওই ব্যক্তিটিকে। প্রতি সপ্তাহে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসে দেখে যাবেন এমন প্রতিশ্রুতিতে মাদকাসক্তদের রিহ্যাব সেন্টারগুলোতে ভর্তি করা হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটে না। দুয়েকটি সেন্টারে চিকিৎসক আনা হলেও হলেও তা ২/৩ মাসে মাত্র একবার। অভিযোগ রয়েছে, সেন্টারে ভর্তি অবস্থায় জ্বর, দাঁত ব্যথা বা মাথা ব্যথার মতো সাধারণ রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত চিকিৎসা দেন সেন্টারের নিজস্ব রিকভারি (আগে নেশাসক্ত ছিলেন) বা এ জাতীয় কেউ। কিন্তু অভিভাবকের কাছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ- এ সকল কেন্দ্রে নির্যাতন ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো চিকিৎসা হয় না। যে কারণে তিন-চার মাস রিহ্যাব সেন্টারে থাকার পরও ৮০/৯০ ভাগ মাদকাসক্ত ফিরে গিয়ে আবারও মাদকের কাছেই ছুটে যান। রিহ্যাব সেন্টারে ছিলেন-এমন একাধিক মাদকাসক্তের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পর ওই মাদকাসক্ত পরিবারের সদস্যদের উপর অভিমান করে কিংবা নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতিকে মাদককে আরো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেন। বাঁধন মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল আহমদ খান তারটির পাশাপাশি অন্যান্য রিহ্যাব সেন্টারে নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন কোনো সেন্টারেই নির্যাতনের মাধ্যমে চিকিৎসা হয় না। আমরা তাদের ওষুধ দিই এবং কাউন্সেলিং করি।