থ্যালাসেমিয়া : বংশগত রক্তের সমস্যা

রক্তের লোহিত রক্ত কণিকার মধ্যে একটি হেম ও চারটি গ্লোবিন চেইনের সংযুক্তিতে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। দুই ধরনের গ্লোবিন চেইন থাকে। একটি আলফা, অন্যটি নন-আলফা। যেমন- বেটা, গামা, ডেলটা। মাতৃগর্ভে এক জোড়া আলফা ও এক জোড়া গামা চেইনের সাহায্যে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। একে বলে ভ্রুণের হিমোগ্লোবিন বা হিমোগ্লোবিন এফ। শিশুর জন্মের তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ হিমোগ্লোবিন বা ‘হিমোগ্লোবিন এ’ এক জোড়া আলফা ও এক জোড়া বেটা চেইন দ্বারা তৈরি হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৯৭ শতাংশ। অন্য একটি হিমোগ্লোবিন এক জোড়া আলফা ও এক জোড়া বেটা চেইন দ্বারা তৈরি হয়, তাকে বলে ‘হিমোগ্লোবিন এ২’, যার পরিমাণ রক্তে প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ। হিমোগ্লোবিনের কাজ কী : অক্সিজেনকে শরীরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে প্রবাহিত করে। রক্তস্বল্পতা কী : কোনো কারণে রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বয়স ও লিঙ্গের স্বাভাবিকের সর্বনি¤œ পরিমাণের নিচে নেমে গেলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে রক্তস্বল্পতা বলে। থ্যালাসেমিয়া কেন হয়? কত প্রকার ও এই রোগের লক্ষণ কী : ক্রোমজোমের যে অংশ গ্লোবিন জিন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সে অংশের ত্রুটি এই রোগের কারণ। এই ত্রুটি বংশানুক্রমিকভাবে মা-বাবার থেকে সন্তানের শরীরে যায়। থ্যালাসেমিয়া সাধারণত দুই প্রকার। (১) আলফা থ্যালাসেমিয়া (২) বেটা থ্যালাসেমিয়া এ ছাড়া থ্যালাসেমিয়ার সাথে গঠনগত ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন যেমন হিমোগ্লোবিন ‘ই’ যুক্ত হয়ে ‘হিমোগ্লোবিন ই থ্যালাসেমিয়া’ হতে পারে। আবার ‘হিমোগ্লোবিন এফ’ শিশুর জন্মেরও তিন মাস পরে রক্তে বেশি পরিমাণে থেকে গেলেও এ রোগের লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে। আলফা থ্যালাসেমিয়া খুবই মারাত্মক। বেশির ভাগ শিশুই মাতৃগর্ভে মারা যায়, তবে এই রোগ সচরাচর দেখা যায় না। বেটা থ্যালাসেমিয়াই সচরাচর দেখা যায়। বেটা থ্যালাসেমিয়া আবার দুই প্রকার : (১) ‘বেটা থ্যালাসেমিয়া মেজর’ যা সমগোত্রীয়দের হয়, অর্থাৎ যেসব শিশুর ক্রোমজোমের দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ থাকে, যা সে একটা পেয়েছে বাবার থেকে অন্যটি মায়ের থেকে। এদের এই রোগের সব লক্ষণই দেখা যায়। (২) ‘বেটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর’, যা অসমগোত্রীয়দের হয় অর্থাৎ যেসব শিশুর ক্রোমজোমের একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ অন্যটি স্বাভাবিক, এদের অনেক সময় বাহক বলে। এদের মধ্যে রোগের লক্ষণগুলো সাধারণত সুপ্ত থাকে। বেটা চেইনের তৈরি কমে গেলে বেশি করে আলফা চেইন তৈরি হয়, যেগুলো হেইনজ বডিস নামের এক ধরনের বিষাক্ত বস্তু তৈরি করে, যা প্লিহা শরীর থেকে বের করে দেয়। এই প্রক্রিয়ার সময় রক্ত ভেঙে রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয়। * সাধারণত এক বছরের মধ্যেই রোগের লক্ষণ দেখা যায়। (১) শিশু দিন দিন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। (২) প্লিহা ও যকৃৎ বড় হতে থাকে। (৩) কপাল ও মুখের হাড় উঁচু হয়ে মুখমণ্ডলের একটি বিশেষ রূপ ধারণ করে, যাকে থ্যালাসেমিয়া মুখমণ্ডল বলে। (৪) খাবারের অরুচি, বারবার অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়া ও সর্বোপরি শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে। চিকিৎসা : (১) নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১০ গ্রাম/ডেলি-এর উপরে রাখা (২) আয়রন চিলেশন (ক) খাওয়ার ওষুধ-ডিফেরিপ্রন (কেলফার) (খ) ইনজেকশন-ডেসফেরক্সামিন (ডেসফেরল) যা চামড়ার নিচে পাম্পের সাহায্যে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায় (৩) প্লিহার অপসারণ (৪) অস্থিমজ্জার প্রতিস্থাপন, যা খুবই কার্যকর কিন্তু ব্যয়বহুল * এই রোগীদের কখনওই রক্তস্বল্পতার জন্য আয়রন-জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না। তবে ফলিক এসিড, এসকরবিক এসিড বা দুধ-চিনি ছাড়া চা উপকারী। প্রতিরোধ (১) বাহক শনাক্তকরণ ও পরামর্শ (২) ভ্রুণের রোগ শনাক্তকরণ ও গর্ভাবস্থার সমাপ্তিকরণ। এখানে উল্লেখ্য, সম্প্রতি ঢাকার শান্তিনগরে ৪৪/২ চামেলীবাগে আশা থ্যালাসেমিয়া সেন্টার নামে একটি পূর্ণাঙ্গ অলাভজনক সেবামূলক চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেখানে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা ও পরামর্শ পাবে। লেখক : শিশু বিশেষজ্ঞ ও কনসালটেন্ট নিবেদিতা শিশু হাসপাতাল লিঃ, ওয়ারি, ঢাকা। আলসারেটিভ কোলাইটিসে কি অপারেশন করতেই হয়? অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক পূর্বে ইউরোপ ও আমেরিকায় এ রোগ দেখা গেলেও উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে ছিল কদাচিত। তবে বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতি অনুকরণের ফলে আমাদের দেশের জনগণের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে আলসারেটিভ কোলাইটিস। এ রোগটি সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মাঝামাঝি লোকজনের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। আলসারেটিভ কোলাইটিস ঠিক কাদের হয় তার কারণ সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে মামাত, চাচাত, খালাত ও ফুফাত ভাই-বোনদের সন্তানদের মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন কোলনের অন্ত্রগাত্রের আবরণ যদি দুর্বল হয় তবে এ রোগ হতে পারে। কেউ যদি খুবই দুশ্চিন্তায় ভোগে, দুধ কিংবা দুগ্ধজাতীয় খাবার খায় অথবা আমাশয়ে ভোগে তবে আলসারেটিভ কোলাইটিসের উপসর্গগুলো বারবার দেখা দিতে পারে। উপসর্গ: ১. ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়া; ২. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া; ৩. অনেক সময় এমনিতেই মলদ্বার দিয়ে মিউকাস কিংবা আমজাতীয় পদার্থ বের হওয়া; ৪. রক্ত যাওয়া; ৫. তলপেটে মোচড় দেয়া এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড পায়খানার বেগ অনুভব হওয়া; ৬. সময় মতো বাথরুমে যেতে না পারলে; ৭. পায়খানা হয়ে কাপড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং; ৮. ঘন ঘন পাতলা পায়খানা ও রক্ত যাওয়া ফলে রোগীর পানি, লবণ এবং রক্তশূন্যতা দেখা দেয়া ইত্যাদি। সময় মতো চিকিৎসা না করলে কী হতে পারে : ১. কোলনে ক্যান্সার হতে পারে ২. দেহের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে, যেমন-কোমর, মেরুদণ্ড, হাঁটু, পায়ের গোড়ালি, হাতের জয়েন্টে; ৩. চামড়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লাল দাগ অথবা আলসার হতে পারে; ৪. চোখের বিভিন্ন ধরনের প্রদাহজনিত রোগ হয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পারে; ৫. মুখ, হাত ও পায়ে পানি এসে শরীর ফুলে যেতে পারে এবং ৬. জন্ডিস হতে পারে, লিভারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয় লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসা : ওষুধ : সাধারণত স্টেরয়েড ও সালফাসেলজিন জাতীয় ওষুধ দিয়ে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়। তবে মাঝে মধ্যে হাইড্রোকরটিসন, এজাথায়েপ্রিন অথবা সাইক্লোসপোরিন ব্যবহার করলে অনেকের মুখ ও শরীর ফুলে যেতে পারে, মাথার চুল পড়ে যেতে পারে, অনিদ্রা, অরুচি, হাতে-পায়ে জ্বালাপোড়া, বমি বমি ভাবসহ নানাবিধ শারীরিক অসুবিধা হতে পারে। অপারেশন : আলসারেটিভ কোলাইটিসের স্থায়ী চিকিৎসা হতে পারে অপারেশন, তবে সব রোগীর ক্ষেত্রে অপারেশনের দরকার হয় না। যেসব ক্ষেত্রে অপারেশন প্রযোজ্য : ১. রোগীর অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন হলে, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ ব্যবহারের পরও কোনো উন্নতি হয় না; ২. রোগী যদি ঘন ঘন পায়খানায় যেতে যেতে হাঁপিয়ে ওঠেন, পায়খানা ধরে রাখতে পারেন না কিংবা রক্তশূন্যতায় ভোগেন; ৩. দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড ব্যবহার করার পরও, যখন স্টেরয়েড আর কাজ করে না বরং স্টেরয়েড ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন; ৪. কোলনোস্কপি বা সিগময়ডোস্কোপি করার পর যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে। এ অপারেশনের পর পেটে স্থায়ীভাবে মলত্যাগের ব্যাগ লাগাতে হবে কিনা এটি একটি বড় প্রশ্ন। আজকাল জটিল বিশেষ ধরনের অপারেশন করে পেটে স্থায়ী মলত্যাগের ব্যাগ (আইলিওস্টমি) না লাগিয়েও অপারেশন করা যায়। এ অপারেশন করতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং বিশেষভাবে পারদর্শিতার প্রয়োজন হয়।