সিলেটে ঐহিত্য রক্ষা করে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপ‌নি গ্রামে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপ‌রিকর। বারবার চিকিৎসকদেরকে গ্রামে যেতে নির্দেশে দেন। কিন্তু আপনার অধিনস্তরা ২৫০ শয্যার সি‌লে‌ট জেলা হাসপাতাল স্থাপন কর‌তে চা‌চ্ছে এমন এক স্থা‌নে যেখা‌নে দুটি সরকারি হাসপাতাল ই‌তিম‌ধ্যেই আ‌ছে। ৫০০ গ‌জের ম‌ধ্যে ১টি ১৫০০ শয্যার সি‌লেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আরেকটি শামসুদ্দিন মা ও শিশু হাসপাতাল। তাও আবার আনুমা‌নিক ১৬৯ বছরের পুরনো স্থাপত্যকীর্তি ধ্বংস করে। বিষয়টি স‌চেতন মানুষ হি‌সে‌বে আমাদের অবাক করে। বরং হাসপাতালটি গ্রাম এলাকায় না হোক, সিলেট শহরতলীতে নির্মাণ করলে ব‌ঞ্চিত লোকজন বে‌শি উপকৃত হ‌তো। আপ‌নি এ‌টি উপল‌ব্দি কর‌লেও সি‌লে‌টের আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা, স্বাস্থ্য বিভাগ তা ম‌নে ক‌রে না। সিলেটের প্রথম মেডিকেল স্কুল পরবর্তিতে কলেজ হাসপাতাল বর্তমা‌নের এই "আবু সিনা হো‌স্টেলে’’ ছিল। আজ হতে ৩৫ বছর পূর্বে নগরীর সুস্থ চিন্তা চেতনার মানুষজন কলেজ হাসপাতালটিকে নানান বিবেচনায় সে সময়ে নগরীর এক কোণে কাজল হাও‌রে স্থানান্তর করে‌ছি‌লেন। এরপর থে‌কে ব্রি‌টিশ আমলের অপূর্ব স্থাপত্যকী‌র্তি‌টি হয় "আবু-‌সিনা হো‌স্টেল"।আর ৩৫ বছর পর আবার এই হো‌স্টেল‌টি ভে‌ঙ্গে আরেকটি ২৫০ শয্যার হাসপাতাল বানা‌নোর উ‌দ্যোগ শুরু হ‌য়ে‌ছে। আমরা হাসপাতালের বিপক্ষে না। আমরা চাই নগরীর আলীয়া মাদ্রাসা মাঠ, শাহজালাল দরগাহ (র:) ও সি‌লেট জেলা স্টে‌ডিয়া‌মের থে‌কে দূ‌রে কোন নি‌রি‌বি‌লি প‌রি‌বে‌শে হাসপাতাল‌টি নি‌র্মিত হোক। তা‌তে ব‌ঞ্চিত লোকজন বে‌শি ক‌রে স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আস‌তে পা‌রে। আর ব্যস্ততম এই এলাকায় হাসপাতাল হ‌লে যানজ‌টের কব‌লে পড়বে পু‌রো নগরবাসী। এই আবু সিনার ম‌তো একটি প্রাচীন সুন্দর নির্মাণ শৈলী ধ্বংস না ক‌রে এ‌টি সংরক্ষণ এর দাবি জানাচ্ছি। কারন-: ১. এই স্থাপনা সিপাহী বিদ্রোহের অল্প আগে তৈরি বৃহত্তর সিলেটের প্রথম হাসপাতাল। ২. দুইটি বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত এই হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ৩. একাত্তরের এখানে ডা: শামসুদ্দীন, ডা: শ্যামল কা‌ন্তি লালাসহ আরও অনেক মুক্তিকামীকে হত্যা করা হয়েছে। ৪. স্থাপত্য বিবেচনায়, এটি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ‘আসাম প্যাটার্ন’ স্থাপনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই স্থাপত্য ধারায় কোর্ট ইয়ার্ডসহ পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্সের উদাহরণ সমগ্র বাংলাদেশেরই কোথাও নেই। এই ধারার এটিই একমাত্র বিদ্যমান। ৫. এটি সিলেটের সূচনা লগ্নের কলোনিয়াল স্থাপনা। ৬. ভবনের নির্মাণশৈলীতে রয়েছে তিনটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। ভবনের নকশায় একইসাথে যোগ হয়েছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রীতি, আসামের নিজস্ব ধারার নির্মাণশৈলী এবং বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি। (ক) ব্রিটিশ নির্মাণশৈলীর এই ভবনে যোগ হয়েছে আসাম রীতিতে গড়া ঢালু টিনের ছাদ। এই টিনেরো রয়েছে কিছু নিজস্বতা। পানি নিষ্কাশনে রয়েছে এর অনন্য ব্যবস্থা। (খ) আসাম প্যাটার্নের ঢালু চালের সাথে এই ভবনে রয়েছে বায়ু চলাচলের জন্য নির্মিত টাওয়ার। এই টাওয়ার বা চূড়াগুলোর অপূর্ব সমন্বয় এই ভবনের আরেকটি অনন্য ও বিরল বৈশিষ্ট্য। এই রীতির ভবনের ক্ষেত্রে এই স্থাপত্যের তুল্য আর কোনো ভবন বাংলাদেশে নেই। (গ) ভবনের মাঝখানে রয়েছে আয়াতাকার একটি ইন্টারনাল ওপেন কোর্ট বা অভ্যন্তরীন একটি খোলা মাঠ। এই ইন্টারনাল ওপেন কোর্ট বা অভ্যন্তরীন খোলা মাঠটি বাংলার চিরায়ত উঠোন সংস্কৃতির অংশ। এই স্থাপনাকে নষ্ট না করে শহরের অন্য কোন স্থানে হাসপাতাল সহজেই করা যায় এবং তেমন স্থান অনেক আছে যেখানে যৌক্তিকভাবেই এই হাসপাতাল প্রকল্প স্থানান্তর করা যায়। সিলেটের স‌চেতন স্থপ‌তি ও নগরপ‌রিকল্পনা‌বিদরা দা‌বি ক‌রে‌ছেন এ‌টি সংরক্ষণ ক‌রে এখা‌নে মু‌ক্তিযু‌দ্ধসহ সি‌লে‌টের ই‌তিহাস ঐ‌তিহ্য নি‌য়ে এক‌টি মিউ‌জিয়াম তৈ‌রি করা হউক। এক‌টি সাংস্কৃ‌তিক বলয় গ‌ড়ে তোলা হউক। এসব বিষয় বি‌বেচনায় নি‌য়ে গ্রা‌মে ফি‌রে যে‌তে মানুষ‌কে উৎসা‌হিত করার ক্ষে‌ত্রে গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার আপনার যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়ন করতে হ‌লে হাসপাতাল‌টি নগরীর অপর প্রা‌ন্তে নির্মাণ করার জন্য আপনার হস্ত‌ক্ষেপ কামনা কর‌ছি। লেখক: সৌদপ মোহন মিহির