‘তুমি’ রবীন্দ্রনাথ। আমরা তোমাতে করি বাস। তুমি শিখিয়েছো,‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত যেথা গৃহের প্রাচীর।’ বৈশাখের আজকের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রার্থনা,‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।’
তুমি মিশে আছো এ মাটির সনে। বাংলার লাল সবুজের পতাকা যখন ওড়ে, তখন তুমি বেজে ওঠো বীনার মতো মোদের হৃদয় গগন মাঝে। দাবদাহ আর প্রচণ্ড- গর্জনে যখন তোমার গানে বরণ করি বৈশাখের প্রথম দিন, তুমি হেসে ওঠো অলক্ষ্যে আজকের জন্য।
কী এমন রোমাঞ্চ জাগাও কবি! তবে বুঝি আসা শুধু বাঙালির ভালোবাসাবাসিতে রং ছড়াতে! বড় বলতে ইচ্ছে হয় গুরু, তুমি না ‘আসিলে’ বাংলার ঋতু কে সাজাতো অপরূপে। তাই ‘আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’।
আট বছর বয়সেই জানিয়ে দিলে কবিতা লিখতে এসেছো। বারো বছরের বালক যখন ঘোষণা দিলে গানে গানে ভুবন মাতাবে। সেই থেকে না থেকেও আছো প্রচণ্ডভাবে। সাহিত্যের ভেলায় চলেছো যেন অনন্তকাল। ছোটবেলায় স্কুল ছিল বড় বিরাগের। অথচ শান্তিনিকেতন বানালে সোনার মানুষ বানাতে।
‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কখনো পুরনো হয় না। তাই পরম মমতায় প্রতিদিন ভাবি, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর।’
রবীন্দ্রচর্চা মানেইতো জীবনের জয়গান। শুনে শুনে বড় হওয়া-শান্তিনিকেতনের বৃক্ষ ছায়াতল, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলপাড়, হলুদ শাড়িতে রাঙা হয়ে দোল খাওয়া কিশোরী, বাহারি শাড়ি পরা রমনীরা রাবীন্দ্রিক চেতনায় যেন নৃত্য-গানে জীবনে জীবন চেনা। জোড়াসাঁকো নামটা নিলেই তোমার ছবি ভাসে চোখে। ঠাকুরবাড়ির ছোট জমিদার মানেই বাঙালির আপন সংস্কৃতিপাঠ। আহ্! কত যে অপার মহিমা তোমার।
স্বপ্নদ্রষ্টা কবিগুরু কি আর সাধে! কত যত্নে লিখেছো, ‘আজি হতে শতবর্ষ-পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহল ভরে আজি হতে শতবর্ষ-পরে।’ কত শত বছর যে পড়া হবে, তুমি আমি কেউ জানি না।
কে না জানে, রবিঠাকুরের কবিতা, তাঁর গান মানেই প্রেম, বিরহ আর প্রার্থনা। মানবতার বন্দনা যেন স্বয়ং ঈশ্বরেরই স্তুতি। তাতেই বাঙালি জরাজীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে তারুণ্য ও নতুনের বার্তায় প্রতিনিয়ত জাগ্রত হয়। শুধু কি বাঙালি ? বিশ্ব মানবের মন ও মননের চিরসঙ্গী তুমি রবীন্দ্রনাথ।
বিশ্বব্যাপী এত খ্যাতি তুমিই তো প্রথম নিয়ে এলে। তোমার গানে হাসি, তোমার গানে কাঁদি। তুমি সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক কী নও তুমি! পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবর্তনকে তুমি পুরেছিলে আপন হাতের মুঠোর পরে।
বাঙালির চেতনার রং স্পষ্ট হয়েছিল নামের মতো রবির আলোয়। বাঙালির প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করতে কী অসাধারণ ব্যাপ্তি তোমার।
তখন উপমহাদেশ ছিল পরাধীন। চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর। এই সময়ই তুমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তাজগতে আধুনিকতার বীজ বুনে দিয়েছিলে। বাঙালির মানস গঠনে তুমি ছিলে দেবদূতসম। বাঙালিকে আবেগ অনুভূতি প্রকাশের ভাষা দিয়েছ। শিক্ষায়, নান্দনিক বোধে, সাংস্কৃতিক চর্চায়, দৈনন্দিন আবেগ-অনুভূতির অভ্যাসে এবং সাহিত্য-সঙ্গীত- শিল্পকলায় সারাক্ষণ কবি তুমি বিরাজিত। আমাদের নিশ্বাসে-বিশ্বাসে, বুদ্ধি-বোধে-মর্মে-কর্মে তুমি।
প্রেম ভালবাসায়, প্রতিবাদে, আন্দোলনের অঙ্গীকারে এবং স্রষ্টার আরাধনার নিবিষ্টতায় তোমাকে পাই। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে তুমি ছিলে স্বমহিমায় প্রকাশিত। সবাই বলে এক জীবনে তুমি যা লিখেছে, এক জনমে তা পাঠের সাধ্যি নেই কারও। তাই তো যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডের রবীন্দ্ররচনাবলী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডার।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তুমি। প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা ছিল আরেক বিষ্ময়কর বিষয়। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি, ভাবা যায়!
ভবে এসেছিলে ১২৬৮ (১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখে। হিসেব করে দেখি, তোমার আগমনের ১৫৮তম বার্ষিকী আজ। অথচ যেন চির নূতন। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। ১৮৭৫ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ। পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও তোমার ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে।
পরিবারের চাপে ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে ইংল্যান্ডে যেতে হলো । ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা। প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে তুমি ফিরে এলে আপন দেশে। ১৮৮৩ সালে ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে। তোমার ছোঁয়ায় ভবতারিণী হলেন মৃণালিনী দেবী। ১৯১০ সালে রচিত গীতাঞ্জলি দিয়ে ১৯১৩ সালে তুমি নিয়ে এলে বাঙালির প্রথম নোবেল পুরস্কার।
১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া, পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারি তদারকির কাজ শুরু করলে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ী ধন্য হলো। ক্রমেই প্রস্ফুটিত হতে থাকে তোমার ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্র রূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক আর সৌন্দর্যচেতনা। ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্রে, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনায় হয়ে ওঠো ‘বিশাল প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ’।
১৯০১ সালে শিলাইদহ ছেড়ে চলে এলে বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৩০ বছর বয়সে পত্নী বিয়োগ মেনে নিতে হলো তোমাকে। ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ মুষড়ে দেয় তোমাকে। তুমি বাঙালির আনন্দভূবন রচনা করলেও ক্রমে ক্রমে প্রিয় হারানোর আঘাতে আঘাতে ছিলে জর্জরিত। তবু ভেঙে পড়নি। তবে একদিন সব ছাড়তে হয়। ১৯৪১ সালে তুমিও পাড়ি দিলে শেষ যাত্রায়। ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী।’ এই তো জীবন।
জন্মজয়ন্তীতে আজ কেবল বলার আছে, ‘ওগো তুমি নিরুপম, হে ঐশ্বর্যবান/ তোমারে যা দিয়েছিনু তা তোমারি দান,/ গ্রহন করেছ যত/ ঋণী তত করেছ আমায়।’
লেখক:সঞ্জয় নাথ সঞ্জু
মন্তব্য