নতুন সড়ক আইন: প্রস্তুতির অভাবে আইন প্রয়োগে বিলম্ব

‘সড়ক পরিবহন আইন’ কার্যকর হলেও মানছেন না বাসচালকরা। বনানীর কাকলী মোড় এলাকায় শুক্রবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একই পরিবহনের দুটি বাস। ছবি: আনোয়ার হোসেন জয় ‘সড়ক পরিবহন আইন’ কার্যকর হলেও মানছেন না বাসচালকরা। বনানীর কাকলী মোড় এলাকায় শুক্রবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একই পরিবহনের দুটি বাস। ছবি: আনোয়ার হোসেন জয় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মোটা অঙ্কের জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রেখে শুক্রবার থেকে নতুন সড়ক আইন কার্যকর হলেও প্রয়োগ ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতির যেমন অভাব ছিল, ছিল না এ আইনের প্রচারও। ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাস হওয়া এ আইন শুক্রবার প্রথম দিন কোথাও কার্যকর হতে দেখা যায়নি। ট্রাফিক পুলিশ বলছে, আইন লঙ্ঘনের কারণে মামলা ও জরিমানাসহ কিছু বিষয় কার্যকর করতে কিছু দিন সময় লাগবে। নতুন এ আইনে জরিমানার অঙ্ক বড় হওয়ায় সফটওয়্যার হালনাগাদ করাসহ আরও কিছু কাজ বাকি আছে। সূত্র বলছে, ট্রাফিক পুলিশকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুরোপুরি প্রস্তুতও করা যায়নি। জনসচেতনতাও গড়ে উঠেনি সেভাবে। তাই প্রথম দিন কোথাও কোথাও ট্রাফিক পুলিশকে জনসচেতনতা কার্যক্রমে দেখা যায়। নতুন এ আইন সম্পর্কে অনেকে জানেনই না। অনেকে সাধুবাদ জানালেও কেউ বলছেন- আইনে জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে শুক্রবার রাজধানীতে অনেকটাই ছিল ঢিলেঢালা ভাব। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেছেন, সড়ক আইন কার্যকরে পুলিশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তবে মামলা ও জরিমানার ক্ষেত্রে কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে তারপর তারা নতুন জরিমানা ও মামলা কার্যকর করবেন। এতে আরও কয়েক দিন সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের ট্রাফিক সদস্যদের নতুন আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করা হবে। তাছাড়া আমাদের জনবল কম রয়েছে, তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নতুন আইন সম্পর্কে সবার সহযোগিতার পাশাপাশি সচেতন হতে তাগিদ দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। মিরপুর গোলচত্বরে বসিলা-আবদুল্লাপুরগামী পরিস্থান পরিবহনের সুপারভাইজার আবদুর রহমান শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো সার্জেন্ট গাড়ি আটকায়নি। এর চালক আজিজ বলেন, শুনেছি সাজা ও জরিমানার মাত্রাটা অতিরিক্ত। এ আইন কার্যকর থাকলে গাড়ি চালানো ছেড়ে দিতে হবে। শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর শেরেবাংলা নগর, বিজয় সরণি, মিরপুর, তেজগাঁও, মহাখালী, কুড়িল বিশ্বরোডসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নতুন আইনের কার্যকারিতা চোখে পড়েনি। শুক্রবার বলে সড়কে যানবাহনের চাপও ছিল কম। পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, শুক্রবার এমনিতেই যানবাহনের চাপ থাকে কম। আর নতুন আইনের কথা শুনে অনেকেই সড়কে গাড়ি নামাননি। মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট যুগান্তরকে বলেন, নতুন আইনে যেসব বিধান আছে, তা প্রয়োগ করে বিদ্যমান মেশিনে মামলা করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া অ্যানালগ পদ্ধতিতে যে মামলা দেব সেজন্য আমাদের কোনো মামলার ফরমও দেয়া হয়নি। তাছাড়া পুরাতন আইনে তো আর মামলা নেয়া যাচ্ছে না। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। কুড়িল বিশ্বরোড মোড়ে সার্জেন্ট ইমরান যুগান্তরকে বলেন, আজ (শুক্রবার) মামলা ও রেকারিং বন্ধ আছে। শনিবার আমাদের একটা সেমিনার হবে। রোববার থেকে হয়তো নতুন আইন প্রয়োগ দেখতে পাবেন। ট্রাফিক পুলিশের আরেকজন এএসআই যুগান্তরকে বলেন, এখন কিন্তু মানুষ মামলা দিলে প্রশ্ন করে, মামলার ধারা সম্পর্কে বুঝতে চায়। না বোঝাতে পারলে বাজে মন্তব্য করে। আসলে আইন পাস করার আগে এসব বিষয়ে ট্রেনিং বলেন বা সেমিনার বলেন- সে ব্যবস্থাটা করা প্রয়োজন ছিল; তবেই মাঠে কাজ করতে আমাদের জন্য সুবিধা হতো। মহাখালীতে অ্যাপসের বাইকচালক ইয়াসিন আলী বলেন, মগবাজার থেকে মতিঝিল, মতিঝিল থেকে শাহবাগ এবং মহাখালী পর্যন্ত এসেছি কোথাও কোনো সার্জেন্ট ধরেনি। একই কথা বলেন, আগারগাঁও এলাকায় আরেক বাইকচালক আতাউর রহমানও। তিনি বলেন, অন্যান্য দিনে শুক্রবার রাস্তায় সার্জেন্টরা গাড়ি ধরার জন্য ওতপেতে থাকেন। আজকে দেখছি তাদের কোনো তৎপরতা নেই। গুলশানে সিএনজিচালক আবদুর রকিব যুগান্তরকে বলেন, আমি তো সকাল থেকে গাড়ি চালাচ্ছি, কেউ কাগজপত্র চেক করেনি। বিজয় সরণি এলাকায় দায়িত্বরত সার্জেন্ট অথেলো রানা বলেন, আমরা মোটিভেশনাল কার্যক্রম চালাচ্ছি। নতুন আইনের কোন ধারায় কী শাস্তি হতে পারে, সে সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিচ্ছি; যাতে আইনটি সম্পর্কে কারও নেতিবাচক ধারণা তৈরি না হয়। তিনি জানান, অচিরেই আইনের কার্যকারিতা শুরু হবে। তবে একেবারে চাপিয়ে না দিয়ে তা সহনীয় মাত্রায় প্রয়োগ করা হবে। আর সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগের চেয়ে কঠোর এ আইন বাস্তবায়নের জন্য আরও প্রচারণা চালাতে হবে। কারণ সড়ক-মহাসড়কের অনিয়ম বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। এটা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইনটি টেকসই করতে হলে কর্তৃপক্ষকেই আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ অনেক জায়গায় জেব্রা ক্রসিংয়ের যে চিহ্ন সেটাও মুছে গেছে। অনেক জায়গায় ফুটওভার ব্রিজ দরকার, যেখানে তা নেই। তাই সামগ্রিক বাস্তবতায় এ নতুন আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। অবকাঠামোগত ত্রুটিগুলো সমাধান করা না হলে সাধারণ মানুষকে আইন মানাতে কষ্ট হবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, এ আইনের সার্থকতাটা তখনই হবে, যখন আমার ভয় দেখানোর দরকার হবে না। আইনটা যুগোপযোগী করা হয়েছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। প্রয়োগের আগে একটু প্রচারণার দরকার আছে।