করোনাভাইরাস: স্লোভেনিয়া ও হাঙ্গেরিতে বিপাকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

করোনাভাইরাস নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। কোন ধরণের যুদ্ধ নয়, নয় কোনও ধরণের সামরিক অভিযান কিংবা কোন ধরণের পারমাণবিক অভিযান। অতি ক্ষুদ্র এক ধরণের আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবী অসহায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ২০৫টি দেশে এ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মানুষ এ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন, ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরিও এর ব্যতিক্রম নয়। এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন ১,৩৪৪ জন। এছাড়া এ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৭ জন এবং সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৯৭ জন। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরিতে এখন করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন ২,০৯৮ জন। এছাড়া এ করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন পর্যন্ত হাঙ্গেরিতে মৃত্যুবরণ করেছেন ২১৩ জন। করোনাভাইরাসের মহামারি প্রাদুর্ভাব রোধ করার জন্য দুইটি দেশই গত মাস থেকে জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং কিছু নির্দিষ্ট সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন হাসপাতাল, ব্যাংক, ফার্মেসি, খাবারের দোকান, সুপার শপ, পেট্রোল স্টেশন ছাড়া বাকি সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কাউকে ঘর থেকে বাইরে বের না হওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন, গ্রিস, অস্ট্রিয়া ইউরোপের এ সকল দেশের মতো বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস যদিও স্লোভেনিয়া কিংবা হাঙ্গেরিতে নেই, তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি দেশ দুইটিতে বসবাস করেন। হাঙ্গেরিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে হাঙ্গেরির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির ফলে "স্টাইপেন্ডিয়াম হাঙ্গেরিকাম" নামক শিক্ষাবৃত্তির অধীনে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রায় ১০০ জনের মতো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডিসহ বিভিন্ন লেভেলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। পাশাপাশি আরও বেশ কিছু শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা নিজ খরচে হাঙ্গেরির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন। হাঙ্গেরিতে বসবাসরত বেশিরভাগ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বসবাস রাজধানী বুদাপেস্ট কিংবা দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ডাবরিচেনে। এছাড়াও অল্প কিছু বাংলাদেশি রয়েছেন যারা বিভিন্ন পেশাভিত্তিক কাজের সঙ্গে জড়িত এবং বুদাপেস্টে বাংলাদেশি মালিকানাধীন দুইটি রেস্টুরেন্টও রয়েছে। সব মিলিয়ে দুইশো থেকে আড়াইশোর মতো বাংলাদেশির বসবাস রয়েছে পূর্ব ইউরোপের এ দেশে। অন্যদিকে স্লোভেনিয়ার কথা বলতে গেলে স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী এবং অন্যরা বিভিন্ন পেশাভিত্তিক কাজের সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানাতে বাংলাদেশি মালিকানাধীন দুইটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়া এবং হাঙ্গেরি এ দুইটি দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনকে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশ বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় এ দুইটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে। আর দুইটি দেশেরই বর্তমান সরকারের কট্টর জাতীয়তাবাদী ও ডানপন্থী মনোভাবের কারণে সেখানে বসবাসরত অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরাও উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সরকারের ঘোষিত সহায়তার অংশীদার হবেন। যেমনটি পর্তুগাল, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্সের ক্ষেত্রে সকলে লক্ষ্য করছে স্লোভেনিয়া এবং হাঙ্গেরির ক্ষেত্রে তেমনটি আশা করা যাচ্ছে না। এছাড়াও এ দুইটি দেশে বাংলাদেশের কোনও দূতাবাস না থাকায় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে যে কোন প্রয়োজনে এ দুই দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাষ্ট্রীয় সকল প্রয়োজনে সহায়তা করে থাকে। তবে এ ধরণের পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত ইউরোপের অন্যান্য দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের মতো অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এ সকল প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহায়তা করার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত আসেনি। তন্ময় ওবালডিন গমেজ একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, যিনি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে অবস্থিত কোদোলানি ইয়ানোস ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে ব্যাচেলর সম্পন্ন করছেন বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ওপর। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশের প্রেক্ষিতে তাকে বাসায় অবস্থান করতে হচ্ছে। পার্টটাইম কাজ করে যেটুকু আয় হতো প্রত্যেক মাসে তা দিয়ে কোনভাবে নিজের থাকা-খাওয়া বাবদ নিজের মাসিক খরচের সংস্থান করা সম্ভব হতো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এ সময় বলতে গেলে তার কাজ নেই। নিজের কাছে যে সামান্য সঞ্চয়টুকু ছিল সেটি দিয়েও আর বেশি দিন সেভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে না এবং এমন সময় বাসা থেকেও তার পক্ষে নিজের মাসিক খরচ নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে হাঙ্গেরিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রিয়া, জার্মানির মতো ইউরোপের অন্যান্য দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মতো সে অর্থে তেমন অবস্থাসম্পন্ন না হওয়ায় এবং হাঙ্গেরিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের তেমন কোন সুসংগঠিত কমিউনিটি না থাকায় কেউই কাউকে সেভাবে সহায়তা করতে পারছেন না। মধ্য ইউরোপে অবস্থিত ছোট্ট দেশ স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও অবস্থা অনেকটা একই রকমের। তৌসিফ রহমান একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যিনি ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানার অধীনে ইরাসমাস মুন্ডুস শিক্ষাবৃত্তির অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করছেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ দুর্দিনে স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউই নেই। হাঙ্গেরির মতো স্লোভেনিয়াতেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে সে রকম কার্যকরী কোনও কমিউনিটি না থাকায় এ সময় একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। অন্যদিকে এখানে যারা প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন তাদের কেউই স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল ইউরোপের এ সকল দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মতো সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক কোন দিক থেকেই তেমন উঁচু অবস্থানে নেই। এজন্য এ সকল দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা একে অপরকে সহায়তা করতে পারবেন তেমনটি এখানে বলাটা দুষ্কর। আক্ষরিক অর্থে এ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সারা পৃথিবীকে এমন একটি অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, যার প্রভাবে গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থমকে গিয়েছে। স্লোভেনিয়া কিংবা হাঙ্গেরি ইউরোপের এ দুইটি দেশ হয়তো বা বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়, আর এ কারণে সারা বছরই বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোতে এ দুইটি দেশ নিয়ে সেরকম খবরও প্রকাশিত হয় না। সূর্য যখন পশ্চিম গগনে অস্ত যায় চারিদিক তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পরে। ঠিক একইভাবে এ দুইটি দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও সুখ-দুঃখ,-আনন্দ-বেদনার মতো সকল অনুভূতি এভাবে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। প্রতিদিন খবরের কাগজে শত খবর প্রকাশিত হলেও তাদের জীবন পাতার অনেক খবর অগোচরেই থেকে যায়। সম্প্রতি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে থাকা অনেকের মতো তাদের জীবনকেও এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঠেলে দিয়েছে। তাই এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার এবং একই সঙ্গে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন স্থানীয় বাংলাদেশি প্রবাসীরা।