জামালপুরের এক পরিচিত ভদ্রলোকের ফোন পেলাম। তার কাতর কণ্ঠ। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। একটি কোম্পানিতে ছোটখাটো পদে চাকরি করেন। তা দিয়ে অতি কষ্টে সংসার চললেও তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো কঠিন। ছোট দুই মেয়ে স্কুলে পড়ে। বড় ছেলেটি স্থানীয় একটি সরকারি কলেজে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স পড়ছে। বছরে দু’বার তিনি ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সহায়তার জন্য পরিচিতজনের কাছে ছুটে আসেন। একবার ভর্তির জন্য, আরেকবার পরীক্ষার ফি নেয়ার জন্য। আমার ধারণা, এদেশে এমন অভিভাবকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বছরের মাঝখানে তিনি ফোন করলেন। বললেন- স্যার, ছেলেটার লেখাপড়া বোধহয় চালানো যাবে না। কলেজ থেকে জানিয়েছে সরকারি আদেশ এসেছে অনলাইনে ক্লাস নিতে হবে। ছেলেকে এক্ষুনি একটি ল্যাপটপ অথবা ফোরজি দামি স্মার্টফোন কিনে দিতে হবে। করোনার কারণে বেতন ঠিকমতো পাচ্ছি না। রিলিফের চালের আশায় থাকতে হয়। এই আমি ল্যাপটপ বা ফোন কিনব কীভাবে? আমরা যারা মাটি-মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি; তারা জানি, শুধু ল্যাপটপ নয়, ইন্টারনেটের ডেটা কেনার যে খরচ আছে এ সময়ে, তা মেটানোর ক্ষমতা একটি বড় সংখ্যক অভিভাবকেরই নেই। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকও আর্থিক সংকটের কারণে প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারেননি। মফস্বল অঞ্চলের কতজন শিক্ষকের প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সক্ষমতা রয়েছে, তা অনুসন্ধানের বিষয়। আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো তাদের অন্যতম প্রধান শক্তি আমলাদের গাড়ি-বাড়ির সহজ সুবিধার ব্যবস্থা করলেও শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বড় কোনো প্রণোদনা দেয়নি কখনও। এটি ঠিক, করোনা সংকট কতদিন থাকবে, আমরা জানি না। তাই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, আমাদের শিক্ষার ভুবন অনির্দিষ্টকালের জন্য থমকে থাকবে কিনা! বর্তমান বাস্তবতায় এটি জটিল প্রশ্ন বটে। আবার সবার শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত না করে বৈষম্য সৃষ্টি করলে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রতিবাদ করবে। এর মধ্যে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক রকম নির্দেশনা; আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আরেক রকম। ইউজিসির নির্দেশনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও চেয়ারম্যান মহোদয়রা তাদের সুপারিশ পাঠিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তা উপস্থাপন করবে ইউজিসির কাছে। এরপর সম্ভবত ইউজিসি সিদ্ধান্ত দেবে। জানি, সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষার ধারা সচল রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যে আদেশ জারি করছি; তা বাস্তবতা মেনে করছি কিনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২ হাজার ২৬০টি কলেজকে অনলাইন ক্লাস নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, ক্ষেত্র প্রস্তুত কিনা তা বিবেচনায় না রেখেই অমন নির্দেশনা এসেছে। আমাদের কলেজগুলো তো শিক্ষার মান রক্ষার চিন্তা বাদ দিয়েছে অনেক আগেই। নির্দেশনামায় ভিসি মহোদয় তো বলেছেনই, দীর্ঘ সেশনজট তিনি কমিয়েছেন ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালিয়ে। কথা সত্যি। সেশনজট কমিয়েছেন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। এই ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ নিয়ে কাগজে আমাদের অনেকবার লিখতে হয়েছে। সেশনজট কমানোর জন্য এই প্রোগ্রাম চালাতে গিয়ে একের পর এক পরীক্ষা নিতে হয়েছে। ক্লাসে পড়ানোর সুযোগ পাওয়া যেত না। লাগাতার পরীক্ষা সিডিউলে পড়ানোর জন্য অধিকাংশ সময়ে ক্লাশরুম ফাঁকা পাওয়া যেত না। শিক্ষার্থীরা ছোট্ট ‘সাজেশনের’ ওপর ভর করে পরীক্ষার বৈতরণী পাড়ি দিত সহজেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খুশি, তারা সেশনজট কমানোর কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে। শিক্ষার্থীদের বড় অংশ খুশি এ কারণে যে, পড়াশোনা ছাড়াই সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে এই ধারাবাহিকতাই হয়তো বজায় থাকবে। যেহেতু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তাই এই অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের খোঁজখবর আমার কাছে বেশি। আমার ধারণা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৪০ ভাগ ছাত্রছাত্রী টিউশন করে এবং আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় অতি কষ্টে পড়াশোনা চালায়। একটি ছোট অংশ আছে, যারা হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। মেধার গুণে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। এদের অনেক ক্ষেত্রে হল কর্তৃপক্ষ ডাইনিংয়ে ফ্রি খাইয়ে, শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে পড়ার খরচ চালান। এরা সবাই এখন যার যার গ্রামে। আমার এক ছাত্রীর কথা মনে পড়ছে। বাবা অসুস্থ, চার ভাইবোনের সংসার। বড় ভাই বিলে-ঝিলে মাছ ধরে তা বিক্রি করে সংসার চালায়। তিনবেলা খাওয়ার কথা ওরা কখনও ভাবে না। মেধাবী ছাত্রী। তাই স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের সাহায্যে পড়াশোনা করে এ পর্যন্ত এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিছাঁটায় সাধারণত বাড়ি যেত না। আমি জিজ্ঞেস করায় বলল, আমি গেলে ভাইকে বাড়তি আরেকজনের জন্য খাবার জোগাড় করতে হবে। এমন শিক্ষার্থীর অনলাইন তো স্বপ্ন-কল্পনা। অনেক সামর্থ্যবান শিক্ষার্থী জানাচ্ছে, এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে ওরা যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া কঠিন। পেলেও এত স্লো যে, অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত কলেজগুলোয় অনলাইন ক্লাস শুরুর নির্দেশনা দিয়েছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, যাদের অনলাইন সুবিধা নেই; তাদের দ্রুত এ প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে করা হবে, তার নির্দেশনা নেই। বাস্তবতার সঙ্গে এসব নির্দেশনার সম্পর্ক থাকে কিনা, আমি জানি না। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখার একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বললাম, যিনি অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি গড়ে ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীকে সংযুক্ত করতে পারছেন। ঢাকা শহরের দুটি বিখ্যাত সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গেও কথা হল। অনলাইন ক্লাসে তাদের ফলাফলও অভিন্ন। এখন বিবেচনা করতে হবে, শহরাঞ্চলের কলেজগুলোর পরিসংখ্যান যদি এমন হয়; জেলা শহর ও উপজেলার সরকারি ও বেসরকারি কলেজের অবস্থা কেমন হবে! গড়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে (আনুমানিক) বাইরে রেখে এ কেমন শিক্ষাক্রম চালিয়ে যাওয়া! তারপরও আমাদের দেশের বাস্তবতায় ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় থিওরি ক্লাস না হয় নেয়া হল, ব্যবহারিক ক্লাস কেমন করে হবে! বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান বিষয়ের অনেক ক্লাসই ল্যাবে হাতে-কলামে করাতে হয়। এটি সামাল দেব কেমন করে! আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে তিন বছরে তিনটি বাধ্যতামূলক ফিল্ডওয়ার্ক আছে। মাঠ প্রত্নতত্ত্ব বাদে প্রত্নতত্ত্ব পাঠ সম্পন্ন হবে কীভাবে! এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের স্নেহভাজন শিক্ষক বললেন, এদের ডিজাইন ক্লাসগুলো হাতে ধরে ধরে শেখাতে হয়। এখন যেভাবে জোড়াতালি দিয়ে শেষ করে ওদের হাতে সর্টিফিকেট তুলে দেব- তাতে ওরা কি স্থপতি হয়ে উঠতে পারবে! সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে, আমরা দায়িত্ববানরা যার যার জায়গা থেকে কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে চাই। সরকার চায় এ কথা জোরগলায় বলতে যে, এই বিশ্বব্যাপী দুর্যোগেও আমার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলতে চায়, আমরা পড়ালেখা না করিয়ে সেশনজট কমিয়ে ফেলেছি; এখন কলেজে কলেজে অনলাইন চালু করে দিয়েছি। এতে কত শতাংশ শিক্ষক আর শিক্ষার্থী যুক্ত হতে পারছেন, জ্ঞানার্জন করতে পারছেন, তা খোঁজ করার দরকার নেই। বাণিজ্য বুদ্ধিকে বাঁচিয়ে রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে, কোনোরকম জোড়াতালিতে এক সেমিস্টার বিদায় করে আরেক সেমিস্টার শুরু করতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি নির্দেশনা মেনে ‘গিনিপিগ’ শিক্ষার্থীদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দিয়ে শিক্ষাক্রম সচল রাখার বিজয়কেতন ওড়াতে চায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় চায় বাস্তব শিক্ষা যাই হোক, কঠোর নির্দেশে অনলাইন ব্যবস্থা চালু রাখতে পেরেছে এই কৃতিত্ব প্রচার করতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পুরো ব্যবস্থাটিকে আমরা সামাল দেব কেমন করে! অনেক শিক্ষার্থীর দুশ্চিন্তা- একটি বছর পিছিয়ে গেলে চাকরি খোঁজার যুদ্ধে এক বছর পিছিয়ে পড়তে হবে। এ ছাড়াও দিনের পর দিন শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে; এতে বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি হবে। এ থেকে তাদের মুক্ত করব কেমন করে! তাই আমাদের প্রথম বিবেচনা হওয়া উচিত- জোড়াতালি দিয়ে সামাল দেয়া শিক্ষা কোনোমতেই শিক্ষা হতে পারে না। অনলাইন সুবিধা না পাওয়া একটি অংশকে বাইরে রেখে বৈষম্যমূলক শিক্ষা সচল রাখা কোনোভাবেই ন্যায়ানুগ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আমাদের এক বছর একাডেমিক শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছিল। তারপরও তো সামাল দেয়া গেছে। করোনার মতো দুর্যোগ পরিস্থিতির কথা তো আগে ভাবা যায়নি। এটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই আমরা যদি উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবহার দেখে নিজেদের অনুরূপ শক্তিশালী ভাবি, তাহলে একে স্বপ্ন-কল্পনা বলাই ন্যায়সঙ্গত হবে। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির সংযোগ প্রধান শর্ত। এসব দিকে না তাকিয়ে এই লকডাউন অবস্থায় কর্তৃপক্ষ যদি আদেশ জারি করে দায়িত্ব শেষ করতে চায়, তবে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। আমরা জানি না, করোনা পরিস্থিতি কত দীর্ঘায়িত হবে। আমরা ভালোটাই আশা করছি। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন ও ওষুধ উদ্ভাবনের কথা শোনা যাচ্ছে। তেমনটি হলে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের সুখবরই পাব। আর বিশেষজ্ঞরা তো বলছেন, করোনার তীব্রতা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। তাহলে তো এই শিক্ষাবছরের ভাঙা ক’টা মাসই আছে। এর মধ্যে এই জোড়াতালির শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া কেন! প্রয়োজনে এই করোনাকাল বিবেচনায় এ সময় শিক্ষার্থীদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো যেতে পারে। এতে মানসিক বিষাদগ্রস্ততা থেকে অনেকে বেরুতে পারবে। গ্রামগঞ্জে চলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পক্ষে লাইব্রেরি সুবিধা পাওয়ার কথা নয়। আর শহরাঞ্চলেও লাইব্রেরি সুবিধা এখন পাওয়ার উপায় নেই। তাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারে এসএমএসের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে শিক্ষার্থীদের ক্রিয়েটিভ কোনো বিষয়ে লেখার কাজ দিতে। সুদিন ফেরার পর তারা তা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে জমা দেবে। এজন্য ৫-১০ ভাগ নম্বর চূড়ান্ত ফলাফলে যুক্ত হবে; এর ফলে শিক্ষা-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে না শিক্ষার্থীরা, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এ ধারার আরও বিকল্প ভাবনা অভিজ্ঞ গুণী মানুষ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা ভাবতে পারেন। আমরা চাই, নীতিনির্ধারণ ও আদেশ জারি এমনভাবে হোক; যাতে শিক্ষাদানের মতো সুচারু একটি বিষয় হালকা ও অকার্যকর বিষয়ে পরিণত না হয়।
মন্তব্য