হানিট্রাপ: সুন্দরীফাঁদ

রাজনৈতিক প্রতিশোধ অথবা সুপার পাওয়ারের লড়াইয়ে হানিট্রাপ বা সুন্দরী নারীর ফাঁদ ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কোন রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য বের করে আনতে এমন ফাঁদে পা দিয়েছেন বাঘা বাঘা অনেক মানুষ। তা নিয়ে আছে রসালো সব কাহিনী। এ নিয়ে আলোচনা নতুন না হলেও, এমন ফাঁদের নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে চীন এমন অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের। সত্যিকার অর্থে এমন ফাঁদে পা দিয়েছিলেন লন্ডনের ইয়ান ক্লিমেন্ট। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে সরকারি সফরে গিয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি লন্ডনের মেয়র বরিস জনসনের ডেপুটি ছিলেন। সেই ইয়ান ক্লিমেন্ট গর্জিয়াস এক সুন্দরীর ফাঁদে পড়েছিলেন এক পার্টিতে। একে হানিট্রাপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ওই যুবতীর পাল্লায় পড়ে তিনি ওয়াইন পান করেন। এক পর্যায়ে তিনি তাকে হোটেলকক্ষে আমন্ত্রণ জানান। পরে তিনি যখন চেতনা ফিরে পান, বুঝতে পারেন নেশা প্রয়োগ করে তাকে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। চোখ মেলেই দেখতে পান ওই যুবতী হেলেদুলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রুমের সবকিছু তছনছ করা। এ সম্পর্কে ইয়ান ক্লিমেন্ট বলেন, দেখি আমার ওয়ালেট উন্মুক্ত। শান্তভাবে এটা হাতিয়ে নিয়েছে ওই যুবতী। সাধারণ কোনো চোর ছিল না সে। কারণ, আমার ব্লাকবেরির সব তথ্য সে ডাউনলোড করে নিয়েছে। এভাবেই চীনা যুবতীদের ফাঁদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে ‘হিডেন হ্যান্ড: এক্সপোজিং হাউ দ্য চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি ইন রিশেপিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইতে। এটি লিখেছেন ক্লাইভ হ্যামিলটন এবং মারেইকি ওলবার্গ। বইটি ১৬ই জুলাই প্রকাশ হওয়ার কথা রয়েছে। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন ডেইলি মেইল। উল্লেখ্য, ইয়ান ক্লিমেন্ট লন্ডন অলিম্পিকের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন। লন্ডন গেমসে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়েও তিনি চীনের রাজধানীতে অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেছেন, ওই যুবতী আসলে ছিলেন চীনের সিক্রেট এজেন্ট। কার কি পরিকল্পনা, কে কি করছে কোথায়- তা লুফে নেয়াই ছিল তার কাজ। এ কাহিনী যখন গত বছর প্রকাশ পায় তখন পত্রিকাগুলোর কাছে এ তথ্য প্রকাশ করেন ইয়ান। তিনি মনে করেন পশ্চিমা বহু রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী এভাবে চীনের হানিট্রাপে পড়ছে। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে বৃটেনের এমআই ৫ ব্যবসার জন্য একটি সুরক্ষিত ম্যানুয়াল বা নিয়মনীতি লিপিবদ্ধ করে, যারা চীন সফরে যাবেন তাদের জন্য। এতে বলা হয়েছিল, অত্যধিক চাটুকারিতা এবং গর্জিয়াস সেবার ক্ষেত্রে বিশেষ করে সতর্ক থাকতে হবে। বন্ধু বানানোর জন্য পশ্চিমারা টার্গেটে থাকেন বেশি। এর মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে বেঁধে ফেলা হয়। সুবিধা পাওয়ার বিনিময়ে এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন পরামর্শের পর ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও বহু মানুষ এমন আহ্বান অবজ্ঞা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনার শতকরা ৯০ ভাগের সঙ্গে জড়িত চীন। একাজ করতে গিয়ে শিল্প বিষয়ক বিপুল পরিমাণ গুপ্তচরের উৎস ব্যবহার করে। তাদের টার্গেট থাকে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা, সরকার এবং সামরিক বাহিনীর গোপনীয়তা হাতে পাওয়া। অন্য দেশের প্রযুক্তি বিষয়ে চীনের রয়েছে বিপুল আগ্রহ। সেটা পেতে তারা আইনগতভাবে হোক বা অন্য যেভাবেই হোক না কেন, তার তোয়াক্কা করে না। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি চুরি করতে তারা শুধু তাদের কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সার্ভিসকেই ব্যবহার করে না। একই সঙ্গে তারা বিদেশে অবস্থানরত চীনা সম্প্রদায়ের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তাদেরকে ইনফর্মার বা গুপ্তচর বানায়। যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইয়ের একজন সিনিয়র সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকর্তা ২০১৮ সালের শেষের দিকে দেখতে পান যে, এই ব্যুরোটি এমন হাজার হাজার অভিযোগ নিয়ে কাজ করেছে। তদন্ত করেছে। এর বেশির ভাগের সঙ্গে চীন জড়িয়ে আছে। পেশাগত বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে গুপ্তচরবৃত্তিতে। তবে এক্ষেত্রে চীন নতুন একটি কৌশল অবলম্ব করেছে। তাকে বলা হয়, ‘থাউজ্যান্ড গ্রেইনস অব স্যান্ড’ স্ট্র্যাটেজি। এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার অ্যামেচারকে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছেন পেশাদার, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী এমনকি পর্যটক। বিভিন্ন দূতাবাস ও কনস্যুলেটে থাকা ব্যক্তিদের কাছে তথ্য সরবরাহ করে তারা। অভিযোগ আছে, ২০১৮ সালে হুয়াওয়ে টেলিকম থেকে সরবরাহ করা সরঞ্জামের মাধ্যমে আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর সফতরের গোপনীয় তথ্য চুরি করা হয়েছে। পাঁচ বছর ধরে প্রতি রাতে বিপুল পরিমাণ ডাটা ডাউনলোড করা হতো এবং তা সাংহাইয়ের সার্ভারে পাঠিয়ে দেয়া হতো। এমন অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রেরও। তথ্য সংগ্রহ করতে বা গুপ্তচর দলে টানতে ব্যবহার করা হয় ইগো, যৌনতা, আদর্শ, দেশপ্রেম এমনকি অর্থ। এক্ষেত্রে পুরস্কারের অর্থ খুব বড় হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাণিজ্যিক গোপনীয়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ প্রযুক্তি সম্পর্কিত কোনো কোম্পানির কোনো প্রকৌশলীকে প্রস্তাব করা হয় চীনের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দেয়ার জন্য। এ জন্য তাকে দেয়া হয় খরচ ও বৃত্তি। এফবিআইয়ের একজন কর্মচারী জোই চুন’কে ব্যুরোর কর্মকা- সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি চীনা এজেন্টদের কাছে বিনামূল্যে আন্তর্জাতিক সফর এবং পতিতাসম্পর্কের বিনিময়ে তথ্য বিনিময় করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক গ্লেন ডুফি শ্রিভার এক্ষেত্রে এক চীনার প্রেমে পড়ে যান গ্রীষ্মকালীন একটি স্টাডি কর্মসুচির সফরে। সেখান থেকে তিনি চলে যান সাংহাইয়ে। সাংহাইয়ে তিনি একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপনে সাড়া দেন। ওই পত্রিকাটি বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে লেখার জন্য কাউকে খুঁজছিল। তিনি এই সুযোগ নিয়ে নেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্টের জন্য তাকে দেয়া হয় ১২০ ডলার। আস্তে আস্তে তিনি সেখানে বন্ধুত্ব করে তোলেন এবং তাকে অধিক অর্থ প্রস্তাব করা হয়। তাকে উৎসাহিত করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সিআইএতে চাকরি খুঁজতে। এসব স্থানে যখন তিনি আবেদন করেন, তখন তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেয়া হয়। তিনি সিআইএর একটি পদের জন্য সাক্ষাতকার দিতে যান ন্যাশনাল ক্লাডেস্টেইন সার্ভিসে। কিন্তু তার চীনা গোয়েন্দা কানেকশন সম্পর্কে অবহিত ছিল এজেন্সি। ব্যস ধরা পড়ে যান। শুনানিতে তিনি বলেন, বিষয়টি আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। বলেছেন, অর্থের কাছে তিনি লোভী হয়ে পড়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষ বসবাস করেন, যা বৃটেনের জনসংখ্যার সমান। তারা বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষার। চীন সম্পর্কে তাদের ধারণা এক এক রকম। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার আগেই তাদের বেশির ভাগ অভিবাসী হয়েছেন। কিন্তু গত দুই থেকে তিন দশকে এসব চীনাকে নিজ দেশে ফেরানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি কাজ করে পারমাণবিক অস্ত্র ও আরএন্ডডি নিয়ে। তাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। এই ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন ল্যাবে নিয়োজিত প্রায় ৩৫ হাজার বিদেশী গবেষক। এর মধ্যে ১০ হাজার চীনা। সিলিকন ভ্যালিতে প্রতি দশজন প্রযুক্তি বিষয়ক কর্মীর মধ্যে একজন চীনের। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, লস আলামোসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ল্যাবে কর্মরত বহু বিজ্ঞানী ফিরে গেছেন চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। একে ‘লস আলামোস ক্লাব’ হিসেবে অভিহিত করেন অনেকে। লোকজনকে পথভ্রষ্ট করতে যৌনতাকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটাই করা হয়েছে ইয়ান ক্লিমেন্টের বেলায়। এ ছাড়া ব্লাকমেইলের ঘটনাতো রয়েছেই। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ফটোগ্রাফ। ২০১৭ সালে এমআই৬ এর সাবেক ডেপুটি প্রধান নাইজেল ইঙ্কস্টার বলেছেন, চীনা এজেন্সিগুলো হানিট্রাপ ব্যবহার করছে। এটা ‘মেইরেন জি’ নামে পরিচিত। আক্ষরিক অর্থে এর অর্থ হলো ‘বিউটিফুল পারসন প্লান’। ২০১৬ সালে এক রিপোর্টে বলা হয় বেইজিংয়ে এমন ফাঁদে পা দিয়েছিলেন ডান একজন রাষ্ট্রদূত।