বাইরের রোগীর চাপে বেসামাল ঢাকার হাসপাতাল

ঘুরছে রোগী এম্বুলেন্সে এম্বুলেন্সে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। কোথাও ঠাঁই নেই। হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা। পুরাতন রোগী ছাড়পত্র পেলেই কেবল নতুন রোগী ভর্তি সম্ভব। এই সংখ্যাটাও খুবই কম। তাই করোনাসহ অন্যান্য রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীদের ভোগান্তি একটু বেশি।

কারণ ঢাকার বাইরের  

 রোগীদের অবস্থা একটু জটিল হলেই উপজেলা বা জেলা হাসপাতালগুলো থেকে রোগীদের ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। অথচ ঢাকায় এসে এসব রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ভর্তি হতে পারছেন না।
অন্যদিকে রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বাভাবিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন।
বাইরে থেকে আসা রোগীদের চাপে ঢাকার হাসপাতালগুলো বেসামাল হয়ে পড়েছে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সকাল ৮টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত বাইরের অন্তত শতাধিক রোগী ভর্তি না হতে পেরে ফিরে গেছেন।
সোমবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের করোনা রোগীদের জরুরি বিভাগের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হয় অর্ধশতাধিক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে। এসব রোগীর অনেকের অবস্থা জটিল। অনেক রোগী আছেন যাদের করোনা উপসর্গ নেই। কিন্তু ঢাকার কোনো হাসপাতালেই তারা ভর্তি হতে পারেননি। কারণ বেসরকারি হাসপাতাল ও করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে করোনা পজিটিভ সার্টিফিকেট ছাড়া ভর্তি নিচ্ছে না। তাই অনেক হাসপাতাল ঘুরার পর তাদের শেষ ভরসা ছিল এই হাসপাতাল। কিন্তু সিট সংকটের কারণে এসব রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। অথচ ১০ মিনিট পরপরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে রোগীরা আসছেন। জরুরি বিভাগে কথা বলে আবার ভর্তি যুদ্ধে ছুটছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আগে থেকেই ঢাকার ও ঢাকার বাইরের রোগীদের চাপ। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াতে বাইরের রোগীদের চাপ বেড়ে গেছে। ঢাকার আশেপাশের প্রতিটি জেলা থেকে প্রতিদিনই করোনা পজিটিভ ও অন্যান্য রোগের জটিল রোগীরা এসে ভিড় করছেন। এদের মধ্যে অনেকের করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট নাই। তাই অনেক হাসপাতাল এসব রোগীদের ভর্তি নিচ্ছে না। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রোগী ভর্তি নিতে চায় না। এতে করে ঘুরেফিরে রোগীরা ঢাকামুখী। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের প্রায় অর্ধেকই ঢাকার বাইরের। হাসপাতাল সূত্র বলছে, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, ভৈরব, বাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুমিল্লাসহ আরও কিছু জেলার রোগীরাই ঢাকায় হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছেন।
৭৫ বছর বয়সী আব্দুল কাদের। সাভারের বাসিন্দা এই ব্যক্তি বেশ কিছুদিন ধরে ডায়াবেটিস ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও তার কষ্ট হচ্ছিল। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তার পরিবারের সদস্যরা তাকে গতকাল সাভারের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু  সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি না নিয়ে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে নিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের কথামতো তাকে আনা হয় বারডেম হাসপাতালে। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরাও ভর্তি না নিয়ে ঢামেকে পাঠিয়ে দেন। ঢামেকে আসার পর সিট না থাকার কথা জানান। পরে কাদেরের স্বজনরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। কাদেরের ছেলে মো. সুলতান মিয়া মানবজমিনকে বলেন, কাল রাত থেকে বাবাকে নিয়ে ঘুরছি। অবস্থা বেশি ভালো না থাকায় হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত এম্বুলেন্সের অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়া বাবার আর কোনো চিকিৎসা দিতে পারি নাই। সাভার থেকে ঢাকায় পাঠানো হলো। কিন্তু কী লাভ হলো? ঢাকার কোনো হাসপাতালেই ভর্তি করাতে পারিনি। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছি। বলতে গেলে কাল রাত থেকে আজ বিকাল পর্যন্ত এম্বুলেন্সেই কাটাচ্ছি।
চাঁদপুরের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী মোবারক মিয়ার শ্বাসকষ্ট বেড়েছে ২-৩দিন ধরে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়াতে তাকে নেয়া হয় চাঁদপুরের সরকারি হাসপাতালে। অক্সিজেন লেভেল কম থাকায় সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ঢাকার মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পজিটিভ সার্টিফিকেট না থাকাতে ঢামেকের পরামর্শ দেন। ঢামেক থেকেও জানানো হয় কোনো সিট খালি নাই। তারা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। মোবারক মিয়ার ভাতিজা জুবায়ের আহমদ বলেন, পরিচিতজনদের মাধ্যমে খোঁজ খবর নিয়েছি কোনো হাসপাতালেই রোগী ভর্তির সুযোগ নাই। একমাত্র ভরসা বেসরকারি হাসপাতাল। আমাদের টাকার জোরও কম। বেসরকারিতে ভর্তি করতে অনেক টাকা দরকার। চাঁদপুর থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে আমাদের কোনো লাভ হয়নি। বরং এখন পর্যন্ত তিনটি অ্যাম্বুলেন্স পরিবর্তন করেছি। প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো ভাড়া দিয়েছি।