পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত একেকটি কিশোর গ্যাংয়ের নাম দেখলে রীতিমতো অবাক
হতে হয়। অদ্ভুত এবং ভয়ংকর সব নাম। অনেক গ্রুপের নামের সঙ্গে আবার সরাসরি
খুনখারাবি অথবা মারধরের ট্যাগ যুক্ত। যেমন মাইরা-লা, কোপায়া দে ইত্যাদি।
রাজধানীতে এ ধরনের ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৭৮টি এবং সদস্য সংখ্যা ২
হাজারের বেশি।
পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের অদ্ভুত সব নামের কী মর্মার্থ তা অনেকেরই জানা
নেই। তবে নামের ধরন দেখে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যে কারও নেতিবাচক ধারণা
তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লিডারের নামে গ্রুপের নামকরণ
হয়ে থাকে। ইভটিজিং, মারধর, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও মাদক ব্যবসা,
ছিনতাই এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং। তাদের উৎপাত আর
অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাং সামাল দিতে
রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
এমন বাস্তবতায় মাঠ পর্যায় থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন করা
হয়েছে। যাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা, সদস্য এবং
পৃষ্ঠপোষকদের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এবারই প্রথম তালিকায় নাম ঠিকানা ও
মোবাইল নম্বরের পাশাপাশি গ্যাং লিডারের ছবিও সংযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের
তৈরি কিশোর গ্যাংয়ের তালিকার একটি কপি সম্প্রতি যুগান্তরের হাতে আসে।
রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত এবং তালিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা
মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দুপুরে তার কার্যালয়ে বলেন, ‘এখন দেখা যাচ্ছে, উঠতি বয়সি ছেলেরা নানাবিধ অপরাধ
কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ছোটখাটো ছিনতাই থেকে শুরু করে মাদক সেবন, মেয়েদের
টিজ করা এমনকি নিজেদের মহল্লায় জুনিয়র-সিনিয়র সংঘাতে খুন পর্যন্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি এটা আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই আমরা তালিকা তৈরি করে
ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে এখন এটা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তাই শুধু পুলিশ একা
নয়, যারা সমাজ নিয়ে ভাবেন তাদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কিশোর গ্যাংয়ের
বিষয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে অভিভাবকদের উচিত হবে সমস্যা লুকিয়ে না রেখে
তারা যেন যথাসময়ে পুলিশের সহায়তা নেয়।’
পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুর
এলাকায়। আর সবচেয়ে কম গুলশানে। এছাড়া তেজগাঁও বিভাগে যথাক্রমে ১৪টি,
মিরপুরে ২৩, উত্তরায় ১১, গুলশানে ১, ওয়ারীতে ৬, মতিঝিলে ১১, রমনায় ৮ এবং
লালবাগে ৪টি গ্রুপ চিহ্নিত হয়েছে। তবে এটিই চূড়ান্ত তালিকা নয়। ইতোমধ্যে
সবগুলো থানাকে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হালনাগাদ রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনা
অনুযায়ী প্রায় প্রতিদিনই কিশোর সন্ত্রাসীদের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত
হচ্ছে।
পুলিশের হালনাগাদ তালিকায় সদস্যদের পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক বা
রাজনৈতিক গডফাদারদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক পদ, পদবি ও
নাম-ঠিকানাসহ এবং মোবাইল নম্বর যুক্ত করে কে কোন গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক তার
বিস্তারিত বিবরণও রয়েছে এ তালিকায়। এতে যেসব রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এসেছে
তাদের বেশির ভাগই পাড়া-মহল্লার উঠতি নেতা বা পাতিনেতা হিসাবে পরিচিত। এছাড়া
বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম আছে তালিকায়। তবে
সূত্রগুলো বলছে, কোনো কোনো গ্রুপের নেপথ্যে রয়েছে একেবারে বড় মাপের
প্রভাবশালী নেতা। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় যাদের নাম তালিকায় স্থান
পায়নি।
পৃষ্ঠপোষক যারা : পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেল্টারদাতা বা
পৃষ্ঠপোষক হিসাবে অর্ধশত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। কেউ কেউ এলাকায় আধিপত্য
বিস্তারে সুবিধার জন্য সরকারি দলের সাইনবোর্ডসর্বস্ব পদ-পদবিও নিয়েছেন।
তালিকায় নাম আছে এমন নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিল্পাঞ্চল থানা
ছাত্রলীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান ওরফে জীবন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক
কাউন্সিলর তালুকদার সারোয়ার হোসেন, মোহাম্মদপুর এলাকার চন্দ্রিমা হাউজিং ও
সিলিকন হাউজিংয়ের মালিক ছারোয়ার ও নাজিব আমজাদ এবং গ্রামবাংলা হাউজিংয়ের
মালিক কবির, ড্রিমল্যান্ড হাউজিংয়ের মালিক সাদিকুর রহমান ওরফে বকুল,
শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ।
আদাবর এলাকার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাশেম, ১০০ নম্বর ওয়ার্ড
যুবলীগের সভাপতি পাপ্পু।
৭৮ কিশোর গ্যাং : রাজধানীর তেজগাঁও থানা এলাকায় সক্রিয় গ্রুপ ১৪টি। এর
সদস্য সংখ্যা ১০৫০ জন। গ্রুপের নামগুলো হলো-কানা জসিম গ্রুপ, মাইন উদ্দিন
গ্রুপ, শাকিল গ্রুপ, মামুন গ্রুপ, লাড়া-দে, চিনে ল, কোপাইয়া দে, বাঁধন
গ্রুপ, পলক গ্রুপ, গাংচিল, ঘুটা দে, চেতাইলেই ভেজাল, দ্যা কিং অব গাইরালা,
ভইরা দে এবং অনলি কোপাইয়া দে গ্রুপ। এছাড়া মিরপুরে সক্রিয় ২৩টি গ্রুপ।
এগুলো হলো-অপু গ্রুপ, আব্বাস গ্রুপ, নাডা ইসমাইল, হ্যাপি, বগা হৃদয়,
ভাস্কর, রবিন, এল কে ডেভিল বা বয়েজ এল কে তালতলা, পটেটো রুবেল, অতুল গ্রুপ,
আশিক গ্রুপ, জল্লা মিলন গ্রুপ, রকি, পিন্টু-কাল্লু গ্রুপ, মুসা হারুন
গ্রুপ ওরফে ভাই ভাই গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, সোহেল গ্রুপ, ইসামিন, ইমন ও
জুয়েল গ্রুপ।
উত্তরা বিভাগে মোট ১১টি গ্রুপ পুলিশের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এগুলো হলো-নাইন
স্টার, এইচবিটি বা হিটার বয়েজ, সানি, ইয়ংস্টার, বিগ বস, রানা ভোলা কিং মহল,
জিদান গ্রুপ, দি বস (হৃদয় গ্যাং)। নামবিহীন আরও ২টি গ্রুপ শনাক্ত করেছে
পুলিশ। গুলশান এলাকায় ডি নাইন নামের মাত্র একটি গ্রুপ শনাক্ত করেছে পুলিশ।
এর সদস্য সংখ্যা ৩০ জনের বেশি। রমনা বিভাগে ৮টি গ্রুপের নাম হচ্ছে বেইলী
কিং রন, অলি গ্রুপ, জসিম, লাভলেন, বাংলা গ্রুপ, পারফেক্ট গ্যাং স্টার বা
পিজিএস, সুমনের গ্রুপ এবং লাড়া-দে। এছাড়া ওয়ারী বিভাগের ৬টি গ্রুপ চিহ্নিত
করা হয়। এগুলো হচ্ছে-শুক্কুর গ্রুপ, লিটন গ্রুপ, তাহমিদ, পলাশ, মোল্লা এবং
সাঈদ গ্রুপ।
রাজধানীর ব্যাংকপাড়া হিসাবে পরিচিত মতিঝিল এলাকায় ১১টি কিশোর গ্যাং পুলিশের
তালিকাভুক্ত। এগুলো হলো-মিম গ্রুপ, চাঁন যাদু, ডেভিল কিং, ফুল পার্টি,
জিসান গ্রুপ, বিচ্ছু বাহিনী, আকিল ও অন্নয় গ্রুপ, নিবিড় গ্রুপ, মাসুদ
গ্রুপ। এছাড়া সক্রিয় আরও ৩টি গ্রুপের নাম জানা যায়নি। পুলিশের লালবাগ
বিভাগে জুম্মন গ্রুপ, বহুল আলোচিত টিকটক হৃদয়, আহম্মেদ পাত্তি গ্রুপ,
ইয়ামিন, ফায়সাল ও নাসির গ্রুপ নামের মোট ৪টি গ্রুপ সক্রিয়।
শিল্পাঞ্চল থানা : তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকায় ২টি গ্রুপ কিশোর গ্যাং
হিসাবে পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত। এর একটির নাম শাকিল গ্রুপ। সদস্য সংখ্যা
১৪-১৫ জন। গ্রুপ লিডার শাকিল হোসেন। তিনি ২৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের
সাংগঠনিক সম্পাদক। তার পিতা এনায়েত হোসেন পেশায় রাজমিস্ত্রি। ঠিকানা ৪৫/১
বেগুনবাড়ি, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, থানা। শাকিল গ্রুপের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা
হলেন- তামিম, সাব্বির, তুষার, রবিন, তপু, রাসেল, মুহিন এবং তুহিন। গ্রুপের
প্রায় সব সদস্য ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শাকিল গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকের
নাম জিল্লুর রহমান জীবন। তিনি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা ছাত্রলীগের
সভাপতি।
পুলিশ বলছে, শাকিল গ্রুপের সদস্যরা শিল্পাঞ্চল থানার বিভিন্ন এলাকায়
সক্রিয়। তবে পদ্মা গার্মেন্ট, সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল, ইয়াং স্টার স্পোর্টিং
ক্লাবের আশপাশে তাদের সার্বক্ষণিক দেখা যায়। ইয়াং স্টার ক্লাবের পাশে
রিকশার গ্যারেজের চিপায় তারা মাদক সেবন করেন। চুলের ছাঁটেও শাকিল গ্রুপের
সদস্যদের বিশেষত্ব রয়েছে। বেশির ভাগ সদস্য জিন্স প্যান্টের সঙ্গে শার্ট পরে
এবং চুলে কদম ফুল ছাঁট দেয়।
এছাড়া শিল্পাঞ্চলে সক্রিয় কিশোর গ্যাং মামুন গ্রুপের নেতার নাম মামুন খান।
তিনি বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সাধারণ সম্পাদক। ৭-৮ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে
তার। নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো হচ্ছে-নাবিস্কো মোড়, নিপ্পন বটতলা, প্রগতি মোড়
এবং নূরানী মোড়ের আশপাশ। গ্রুপের সদস্যরা অবৈধ অটোরিকশা, বিদ্যুৎ সংযোগ,
চাঁদাবাজি, ফুটপাত দখল করে রিকশার গ্যারেজ নির্মাণসহ বেআইনি কর্মকাণ্ড
চালায়। গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে আছেন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর
তালুকদার সারোয়ার হোসেন।
মোহাম্মদপুর : মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ৪টি কিশোর গ্যাং চিহ্নিত করেছে
পুলিশ। এগুলো হচ্ছে-গাংচিল গ্রুপ, ঘুটা দে, চেতাইলেই ভেজাল এবং লাড়া-দে
গ্রুপ। এর মধ্যে গাংচিল গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৪০ জনের মতো। এর লিডার মোশারফ
ওরফে লম্বু মোশারফ। তার ঠিকানা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকার ১ নম্বর এভিনিউ।
নদীতে ডাকাতি, ছিনতাই, ভূমিদস্যুদের ক্যাডার হিসাবে কাজ করেন তিনি। এছাড়া
চুক্তিতে যে কোনো ধরনের খারাপ কাজে তিনি সিদ্ধহস্ত। তার গ্রুপের সদস্যরা
হলেন- লম্বু কবির, মানিক ওরফে বোমা মানিক, ফরহাদ, মাঈন উদ্দিন, রনি,
সাফায়েত, বদরুল, নূরে আলম, আক্তার, মামুন, মোহন, খান আলমগীর, হায়াত, ইউনুস,
মিজান এবং জসিম। পুলিশের তালিকা অনুযায়ী গাংচিল গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হলেন
চন্দ্রিমা হাউজিং ও সিলিকন হাউজিংয়ের মালিক ছারোয়ার, নাজিব আমজাদ এবং
গ্রামবাংলা হাউজিংয়ের মালিক কবির।
মোহাম্মদপুর এলাকায় সক্রিয় ‘ঘুটা দে’ গ্রুপের সদস্য দেড়শর বেশি। নবোদয়
হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায় তারা।
গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ভূমিদস্যুদের ক্যাডার
এমনকি খুনের অভিযোগও আছে। সদস্যরা হলেন নবীনগর হাউজিংয়ের আহম্মেদ, নবোদয়
হাউজিংয়ের ডেভিড আলম, সুনিবিড় হাউজিং এলাকার রাহাত, গোল্ডেন সানি, হাসান,
সোহেল, জাহিদুল, রিয়াজ, আকাশ এবং বিপ্লব। গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক ড্রিমল্যান্ড
হাউজিংয়ের মালিক সাদিকুর রহমান ওরফে বকুল। মোহাম্মদপুরে আরেকটি কুখ্যাত
কিশোর গ্যাংয়ের নাম ‘চেতাইলেই ভেজাল’। শতাধিক সদস্য রয়েছে তাদের। গ্রুপ
লিডারের নাম শান্ত ওরফে বুলেট শান্ত। তিনি সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে
গাড়ি শোরুমের সামনে আড্ডা দেন। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, ছিনতাই এবং
মারামারির অভিযোগ রয়েছে। টিক্কাপাড়া এলাকায় সক্রিয় ‘চেতাইলেই ভেজাল’
গ্রুপের অ্যাডমিনের নাম আরিয়ান ওরফে রহিত। টিক্কাপাড়া, জুহুরী মহল্লা, আজিজ
মহল্লা, সূচনা কমিউনিটি সেন্টার এবং আশপাশের এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে।
গ্রুপের সদস্যরা হলেন-অর্ণব, শেখ রাজিব, রহমান, ইয়াছিন, রাব্বি ও শামিনুর
রহমান।
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড, বাঁশবাড়ী, নূরজাহান রোড এবং কাটাশুর টাউন হল
এলাকায় সক্রিয় ভয়ংকর কিশোর গ্রুপের নাম লাড়া-দে। তাদের স্লোগান
হচ্ছে-‘চিনে-ল’, ‘কোপাইয়া দে’ ইত্যাদি। এ গ্রুপের লিডারের নাম তামিমুর
রহমান ওরফে মীম। ২৫ বছর বয়সি মীমের পিতার নাম একরামুল শেখ। বাঁশবাড়ী এলাকায়
তার বাসা। তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলেও সংশোধন হননি। তার
বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। লাড়া দে গ্রুপের আরেক
সদস্য অভিক ইসলাম ওরফে অভি মাত্র ১৮ বছর বয়সে একাধিকবার কারাগারে যান। তার
বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। লাড়া দে গ্রুপের সদস্য
সংখ্যা অন্তত আড়াইশ জন। সদস্যদের বেশির ভাগই ভিন্ন স্কুল-কলেজের
শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-রবিউল ইসলাম, মেহেদী হাসান,
হৃদয় হোসেন, আরিফুল ইসলাম, সানি ওরফে ডিকে সানি, আজগর আলী, নেছার উদ্দিন
ওরফে হৃদয়, তৌসিক, মানিক, হাসান আশিকুজ্জামান, সাকিল, মেহেদী হাসান, জিসান
আহম্মেদ, রায়হান হোসেন ও শুকরুল ইসলাম ওরফে নাঈম। এদের একটি বড় অংশ
ইতোমধ্যে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে ছিলেন। জামিনে বেরিয়ে ফের তারা গ্যাং
কালচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় মাত্র একটি কিশোর গ্যাং তালিকাভুক্ত
করা হয়। লিডারের নাম জাকির হোসেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে
জড়িত। বসবাস করেন পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার বিএনপি বস্তিতে। তার গ্রুপের
সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে আছে বাংলাদেশ বেতারের আশপাশ, বিএনপি বস্তি, খালপাড়,
শিশুমেলা ও আগারগাঁও এলাকা। ৩০-৩৫ জনের গ্রুপটির অন্য সদস্যরা হলেন-লিমন,
সুজন, রুবেল, মনির হোসেন, সুমন ও সাগর। গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে নাম আছে
শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদের
নাম।
আদাবর : আদাবর এলাকায় সক্রিয় ৩টি গ্রুপ পুলিশের তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে
‘দ্যা কিং অব গাইরালা’ নামের গ্রুপের নেতা শেখ ইয়াসিন। তিনি ছিনতাই ও
মারামারিতে সিদ্ধহস্ত। গ্রুপের সদস্য সংখ্যা দেড়শরও বেশি। বেশির ভাগ সদস্য
পুলিশের খাতায় মাদক ব্যবসায়ী হিসাবে চিহ্নিত। শেকেরটেক, মনসুরাবাদ, আদাবর ও
ঢাকা উদ্যান এলাকায় তাদের আধিপত্য রয়েছে। যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে থানায়
ইতোমধ্যে অভিযোগ রয়েছে তারা হলেন-আরকে রাকিব, মিরাজ, মুরগি শাওন (আলিফ
হাউজিংয়ের বাসিন্দা), শেকেরটেকের ইউসুফ, মামুন, নান্টু ও রাহুল। ৩০ নম্বর
ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাশেমের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এই বাহিনী।
‘ভইরা দে’ নামের আরেকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে শেকেরটেক, শ্যামলী হাউজিং ও
নবোদয় হাউজিং এলাকায়। এ গ্রুপের লিডারের নাম সেলিম। তার ঠিকানা হচ্ছে-খায়ের
সাহেবের বাসা, মালা হাউজিং শেকেরটেক-৬। গ্রুপের সদস্য সংখ্যা শতাধিক।
উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন-সাগর, মিরাজ (গ্রুপ লিডার-১), জুয়েল (গ্রুপ
লিডার-২), শাকিল (গ্রুপ লিডার-৩), রাব্বি টিবি (গ্রুপ লিডার-৪), এরফান ওরফে
সেলিমের ভাগ্নে এরফান, আব্দুল্লাহ আল মঈন, রাব্বি এবং মোমিন ইসতিয়াক
রিয়াজ।
পুলিশ বলছে, গ্রুপের সদস্যরা আল নূরানী তোতামিয়া জামে মসজিদের পাশের ৩য়
তলা, আদবর, শেকেরটেক, শ্যামলী হাউজিং এবং শেকেরটেক ১ নম্বর রোডের মাথায়
সমবেত হয়। এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণেও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাশেমের হাত
রয়েছে।
মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘অনলি কোপাইয়া দে’ নামের একটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা তিন
শতাধিক। গ্রুপ লিডারের নাম তানভীর। মাদক সেবন এবং মারামারিতে পারদর্শী
তানভীরের বয়স মাত্র ১৮ বছর। এছাড়া গ্রুপের অন্য সদস্যরা হলেন-জগৎ, মিঠু,
সুমন ওরফে ওয়ান পিচ সুমন, এমডি পরান, মোহাম্মদ সাব্বির রহমান, বিবিসি
রাকিব, শাহদাৎ। গ্রুপের প্রশ্রয়দাতা হিসাবে ১০০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের
সভাপতি পাপ্পুর নাম আছে।
তেজগাঁও : রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় সক্রিয় ২টি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের
চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে কাওরান বাজার এলাকায় দাপিয়ে
বেড়ায় কানা জসিম গ্রুপ। সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। লিডারের নাম জসিম
উদ্দিন পাটোয়ারী ওরফে জসিম পাটোয়ারী ওরফে কানা জসিম। তার গ্রামের বাড়ি
চাঁদপুরের কামরাঙ্গীবাজার। বর্তমানে তিনি বসবাস করেন মিরপুরের পশ্চিম
কাজীপাড়ায়।
কানা জসিম গ্রুপের অন্য সদস্যরা হলেন তাজুল ইসলাম সোহেল ওরফে কিলার সোহেল,
সাইদুর রহমান ওরফে বাবু, নাজির আহাম্মেদ, জয়-ই মামুন, পারভেজ, শাকির রানা,
রনি শেখ, ইমন হোসেন ও শফিক। গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক জনৈক যুবলীগ নেতা সাব্বির
আলম ওরফে লিটু। গ্রুপের সদস্যদের অনেকেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঘোরাফেরা
করেন।
তেজগাঁও এলাকায় সক্রিয় আরেকটি কিশোর গ্যাং মাইন উদ্দিন গ্রুপ। লিডারের নাম
জাহিদুল ইসলাম ওরফে মাইন। তিনি ২৬ নম্বর ওয়ার্ড শেখ রাসেল শিশু-কিশোর
পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইন ও স্ট্যান্ড
নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে হলিক্রস স্কুল গির্জার
সামনে থেকে নাখালপাড়া পর্যন্ত অটোরিকশা চলাচল তার নিয়ন্ত্রণে। মাইনউদ্দিন
গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে আছেন তেজকুনিপাড়ার গোলাপ, রেলওয়ে কলোনি স্কুলের
বস্তির সোহেল, নাখালপাড়ার জাকির আহাম্মেদ, জায়িজ, গেশু, মনির, রাফছান এবং
জুয়েল। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হক জিল্লু
এবং শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদের তেজগাঁও থানা ইউনিটের সভাপতি আনোয়ার
হোসেন রিপনের নাম আছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হিসাবে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেল্টার বা পৃষ্ঠপোষকতার
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তালুকদার
সারোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, কোনো কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে তার
সম্পৃক্ততা নেই। তবে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে তার রাজনৈতিক বিরোধ
রয়েছে। গত নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করায় তিনি ক্ষিপ্ত
হয়ে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করিয়ে তাকে জেলে পাঠান। এখন তার রাজনৈতিক
নেতাকর্মীদেরকেও সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
শিল্পাঞ্চল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান জীবন তার বিরুদ্ধে
অভিযোগের বিবরণ শুনেছেন। কিন্তু কোনো মন্তব্য করতে চাননি। ঢাকা মহানগর
উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হক জিল্লু অভিযোগ অস্বীকার করে
বলেন, কিশোর গ্যাং প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ একেবারে মিথ্যা। তবে জাহিদুল
ইসলাম মাইন নামের একজনকে তিনি চেনেন যিনি শেখ রাসেল শিশু কিশোর পরিষদের
নেতা। তার সঙ্গে অনেক ছেলে রয়েছে। এক সময় তিনি নিজেও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের
নেতা ছিলেন। তখন থেকেই মাইনকে ভালো ছেলে হিসাবে তিনি চেনেন। তবে কিশোর
গ্যাংয়ের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি কে কিভাবে পুলিশের কাছে দিয়েছে তা
তিনি বুঝতে পারছেন না। সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল
কাশেমের বক্তব্য জানার জন্য তার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি
ফোন ধরেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড.
জিয়া রহমান বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এর কারণ
নিরূপণ করা জরুরি। নানা কারণে কিশোর শ্রেণি বিপথে ধাবিত হয়। এ জন্য সমাজে
অপরাধপ্রবণতা হ্রাস, মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানবিক
আচরণ জরুরি। শুধু পুলিশ দিয়ে নয়, সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। ঝরে
পড়া শিক্ষার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক
বৈষম্যের কারণেও অনেকে গ্যাং কালচারের দিকে ধাবিত হয়। ফলে সামগ্রিক
প্রচেষ্টা নেওয়া না হলে কিশোর গ্যাংয়ের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে সহজে মুক্তি
পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
মন্তব্য