চ্যালেঞ্জের মুখে সরোয়ারের তিন দশকের আধিপত্য

বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ারের টানা ৩০ বছরের একক আধিপত্য আর নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মহানগরে কমিটি গঠনে কেন্দ্রের নেওয়া উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এবারই প্রথম সরোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মহানগরের শীর্ষ নেতৃত্ব পেতে মাঠে নেমেছেন ৪ প্রভাবশালী নেতা। কেবল শীর্ষ নেতৃত্বই নয়, সদস্য সচিব পদের জন্যও জোট বেঁধেছেন সরোয়ারবিরোধীরা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন নব্বইয়ের দশকের ছাত্রদল নেতারা। একক আধিপত্য বজায় রাখতে তাদের বছরের পর বছর কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ রয়েছে সরোয়ারের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ অবশ্য স্বীকার করেননি সাবেক এই এমপি। করোনা মহামারির কারণে সঠিক সময়ে কাউন্সিল করা যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাঠের রাজনীতিতে যারা সক্রিয়, তারাই কমিটির নেতৃত্বে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া আমি চাই কমিটি হোক কাউন্সিলের মাধ্যমে। কাউন্সিলররা তাদের ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করুক।’ একানব্বইয়ের জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল সদর আসন থেকে বিএনপির এমপি হন আব্দুর রহমান বিশ্বাস (প্রয়াত)। তিনি রাষ্ট্রপতি হলে উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন মজিবর রহমান সরোয়ার। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে অবশ্য তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ওই সময় রহমান বিশ্বাসের ছেলে নাসিম বিশ্বাস এমপি নির্বাচিত হন। নাসিমের মৃত্যুর পর আবারও উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে এমপি হন সরোয়ার। সেই থেকে ২০২১-টানা প্রায় ৩০ বছর এখানে বিএনপির রাজনীতি মানেই মজিবর রহমান সরোয়ার। একটা সময় ছিল যখন সরোয়ার ছিলেন একাধারে বরিশালের জেলা মন্ত্রী, জাতীয় সংসদের হুইপ, বরিশালের সিটি মেয়র ও এমপি। সেসময় সিটি মেয়র হিসাবে বরিশালের বাইরে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাও পেতেন তিনি। স্থানীয় কিংবা জাতীয় রাজনীতি প্রশ্নে একই সঙ্গে এতগুলো সাংবিধানিক পদে থাকার এই রেকর্ড এখন পর্যন্ত সরোয়ার ছাড়া দেশের আর কোনো রাজনীতিবিদের নেই। স্থানীয় রাজনীতিতে একক অধিপত্য ধরে রাখা সেই সরোয়ারই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে মূল দলের নেতাকর্মীদের বেশ বড় একটা অংশ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা চান না সরোয়ার বরিশাল মহানগরের নেতৃত্বে থাকুক। এক্ষেত্রে একটি অকাট্য যুক্তিও রয়েছে তাদের। বিএনপিতে যেহেতু এক নেতার এক পদ নীতি চালু হয়েছে, তাই সরোয়ার কেন্দ্রের যুগ্ম মহাসচিব পদেই থাকুক-এমনটাই দাবি তাদের। সরোয়ারের বিরুদ্ধে এখানে সব সময়ই নেতাকর্মীদের একটি অংশ সক্রিয় ছিল। তবে তারা কখনো প্রকাশ্যে আসেননি। ২/১ জন যারা এসেছেন, তারা হয়েছেন চোরাগোপ্তা হামলার শিকার। জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম রাজন হামলায় গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। বিরোধিতা করায় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আরও কয়েকজনের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে আহত করার অভিযোগ থাকলেও তা অবশ্য কখনোই স্বীকার করেননি সরোয়ার। এভাবে কমিটি গঠন থেকে শুরু করে দল পরিচালনা প্রশ্নে সব সময় সরোয়ারই ছিলেন শুরু এবং শেষ। অবশ্য কয়েক বছর ধরে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। নানা কারণে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বির্তকিত হতে শুরু করেন তিনি। আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনামলের ১২ বছরে একদিনের জন্যও গ্রেফতার না হওয়া, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতা, ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে রাখা ও সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থী হয়েও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ছাত্রদল-যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনেও প্রকাশ হতে থাকে সরোয়ারের বিরোধিতা। তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে আলাদা দলীয় কর্মসূচি পালন শুরু করে মহানগর বিএনপির বড় একটা অংশ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয় সরোয়ারের পক্ষ থেকে। নেতৃত্ব আর আধিপত্য প্রশ্নে সরোয়ারের যখন এমন নড়বড়ে অবস্থা, ঠিক সেই সময়ে বরিশাল মহানগর বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল আলম নান্নু জানান, ‘দলকে রাজপথ ও আন্দোলনমুখী করার লক্ষ্যে সারা দেশে মেয়াদ পার করা কমিটিগুলো নতুন করে গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বরিশালও এর বাইরে নয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী মাসেই ঘোষিত হতে পারে মহানগর বিএনপির কমিটি।’ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রথমে গঠন করা হবে আহ্বায়ক কমিটি। এই কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করবে। মহানগরের বর্তমান সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে এখানে আহ্বায়ক পদের জন্য দাঁড়িয়েছেন আরও ৪ জন। তারা হলেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি বিলকিস জাহান শিরিন, সাবেক সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামাল, মহানগর বিএনপির বর্তমান সহসভাপতি মনিরুজ্জামান ফারুক এবং মহানগরের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলী হায়দার বাবুল। সদস্য সচিব পদের জন্যও লড়ছেন বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন মহানগরের বর্তমান সহসভাপতি আকতার হোসেন মেবুল, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর জাহিদুল কবির, মহানগর কমিটি থেকে পদত্যাগ করা শাহ আমিনুল ইসলাম, জেলা যুবদলের সভাপতি আক্তারুজ্জামান শামিম এবং ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা জিএম আতায়ে রাব্বি। তাদের মধ্যে জিয়াউদ্দিন সিকদার ছাড়া বাকিরা নব্বইয়ের দশকের ছাত্রনেতা। নয়া কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে সরোয়ার বলেন, ‘হিসাব অনুযায়ী বহু আগেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে এই কমিটি। নতুন কমিটি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমি চাই যারা নিয়মিত মাঠে ছিলেন, তারাই আসুক নেতৃত্বে।’ সরোয়ারের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে মহানগর বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক খন্দকার আবুল হাসান লিমন বলেন, নব্বইয়ের আন্দোলনসহ সরকারবিরোধী সব আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে সক্রিয় থাকা অগণিত নেতাকর্মী কেন নিষ্ক্রিয় হলো, তা খতিয়ে দেখতে হবে সবার আগে। মীর জাহিদুল কবির বলেন, ‘সারা দেশেই একটা সময়ের পর দলের নেতৃত্বে আসেন সাবেক ছাত্রনেতারা। কেবল বরিশালেই ব্যতিক্রম। এখানে ব্যক্তিস্বার্থে নতুন নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ যেমন দেওয়া হয়নি, তেমনই দলকে রাখা হয়েছে কুক্ষিগত করে। একক আধিপত্য ধরে রাখতে প্রয়োজনমতো পাওয়ারলেস চশমা মার্কা লোকজনকে ধরে এনে বসানো হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। যাদের যোগ্যতা কেবলই জি-হুজুর, জি-হুজুর বলা।’ আহসান হাবিব কামাল বলেন, ‘আসলে এখন একটা পরিবর্তন দরকার। একটানা ৩০ বছর। আর কত?’ আলী হায়দার বাবুল বলেন, ‘২০০৯ সালের আহ্বায়ক কমিটিতে আমি ছিলাম যুগ্ম আহ্বায়ক। অথচ পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আমার মূল্যায়ন হলো না। ১১ বছর ধরে কোনো পদে না থেকেও সাতবার জেল খেটেছি। আর কী পরীক্ষা দিতে হবে?’ মনিরুজ্জামান ফারুক বলেন, ‘নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে এখানে পরিকল্পিতভাবে নেতৃত্বের সংকট তৈরি করে রেখেছেন মজিবর রহমান সরোয়ার। তিনি একাই দখল করেছেন সবকিছু। ২১ বছর ধরে বিএনপিতে আছি। জেল খেটেছি, হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। আজ যখন তার (সরোয়ার) কাছে মূল্যায়ন চাইলাম, তখনই হয়ে গেলাম শত্র“। কেন্দ্রের উচিত এখানে নতুন নেতৃত্ব আনা। বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ‘দলের একটি সিদ্ধান্ত আছে যে একজন নেতা একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে থাকতে পারবে না। এই একটি নির্দেশনাতেই তো ওনার (সরোয়ার) যে কোনো একটি পদ ছেড়ে দিতে হবে। আমি মনে করি, নতুন নেতৃত্ব আসা খুবই জরুরি। তাছাড়া আন্দোলন-সংগ্রামে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরও তো মূল্যায়ন হতে হবে।