লাব্বাইক

লাখো কণ্ঠে সমস্বরে উচ্চারিত হলো- ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্‌দা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক’। অর্থাৎ- ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।’ শুক্রবার পবিত্র জুমার দিন এবার এ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে হজযাত্রীরা পালন করলেন হজ। তারা আল্লাহর দরবারে দমে দমে ফরিয়াদ জানালেন ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। দু’টুকরো সাদা কাপড়ে শরীর ঢেকে এক আল্লাহর ইবাদতে দিন অতিবাহিত করলেন ইসলামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় স্মৃতিবাহী আরাফাতের ময়দানে। এখানেই মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) দিয়েছিলেন তার বিদায় হজের ভাষণ। সেই স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে এবার হজযাত্রীরা আরাফাতে সমবেত হয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, ইবাদত বন্দেগিতে অতিবাহিত করলেন। দীর্ঘ দুই বছর করোনা মহামারির কারণে হজ পালিত হয়েছে বিধি-নিষেধের আওতায়। সীমিত সংখ্যক হজযাত্রী এ সময় হজ পালন করেছেন। কিন্তু এবার সেই বিধি-নিষেধ শিথিল করে ১০ লাখ মুসলিমকে পবিত্র হজ পালনের সুযোগ দিয়েছে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ। এজন্য আবেগে, আনন্দে বিগলিত হজযাত্রীরা। এর আগে গতকাল ভোরে ফজরের নামাজ আদায়ের পর পরই হজযাত্রীরা মিনা থেকে যাত্রা শুরু করেন আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে। আল্লাহকে কাছে পাওয়ার, গোনাহ মাফ পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তারা ছুটে যান আরাফাতের ময়দানে। মুখে মুহুর্মুহু উচ্চারণ করেন- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। তেলাওয়াত করেন। দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দুপুরে মসজিদে নামিরা থেকে বয়ান দেন খতিব মুহাম্মদ আবদুল করিম আল ইসা। এতে তিনি মুসলিম উম্মার শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। মহান আল্লাহর দরবারে সমস্ত পাপের ক্ষমা চান। তুলে ধরেন মহানবী (সা.)-এর রেখে যাওয়া শিক্ষা। সে মতো জীবন পরিচালনার তাগিদ দেন। সেখানে এক আজানে হজযাত্রীরা আদায় করেন জুমা ও আসরের নামাজ। বিভিন্ন রেডিও স্টেশন ও টিভি চ্যানেল তা সারাবিশ্বে সম্প্রচার করে। পবিত্র কাবাঘরকে তাওয়াফ করে বুধবার থেকে হজযাত্রীরা মিনায় সমবেত হতে শুরু করেন। বৃহস্পতিবারও ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে তুচ্ছ করে হজযাত্রীরা পবিত্র কাবা’কে তাওয়াফ করেছেন। এরপর প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মিনায় ছুটে যান। সেখানে দিনের বাকি অংশ ও রাত অতিবাহিত করেন। তারপর ফজরের নামাজের পরই তারা ছুটতে থাকেন পবিত্র আরাফাতের ময়দানে। অনলাইন আরব নিউজ বলছে, হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ। পবিত্র মক্কা নগরীতে এবং মদিনায় হজযাত্রীদের সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২৩টি হাসপাতাল ও ১৪৭টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। মিনায় হজযাত্রীদের চিকিৎসা সুবিধা দিতে প্রস্তুত রাখা হয় ৪টি হাসপাতাল ও ২৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। হজযাত্রীদের আইসিইউ সেবা দেয়ার জন্য কমপক্ষে এক হাজার বেড প্রস্তুত। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাদেরকে সেবা দেয়ার জন্য কমপক্ষে ২০০ বেড প্রস্তুত আছে। হজযাত্রীদের সেবা দিচ্ছেন কমপক্ষে ২৫ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী। এবার অনুমোদিত টিকার পূর্ণ ডোজ নিয়েছেন এমন ১০ লাখ মানুষকে হজ পালনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৮ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি। বাকিরা সৌদি আরবের। এরআগে ২০১৯ সালে সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ২৫ লাখ মুসলিম হজ পালন করেছেন। কিন্তু করোনার কারণে এই সংখ্যা পরের দুই বছর কমিয়ে আনতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালে টিকা নিয়েছেন এমন শুধু ৬০ হাজার সৌদি অধিবাসীকে হজ করার অনুমতি দেয়া হয়। ২০২০ সালে হজ পালন করেন হাতেগোনা কয়েক হাজার মুসলিম। পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা চলে ৫ দিন ধরে। তার মধ্যে আরাফাতের দিবসকে ধরা হয় মূল হজ হিসেবে। মিনা থেকে এদিন ভোর থেকেই হজযাত্রীরা লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন। তাদের সমস্বরে উচ্চারিত লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত হয় আরাফাতের আকাশ-বাতাস। সূর্যাস্তের পর হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করে যাত্রা করেন মুজদালিফার উদ্দেশ্যে। সেখানে আবার তারা এক আজানে আদায় করেন মাগরিব ও এশার নামাজ। তারপর পাথর সংগ্রহ করেন জামারায় প্রতীকী শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য। এদিন রাতে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করেন তারা। আজ শনিবার সকালে সূর্যোদয়ের পর পাথর নিক্ষেপ করবেন হজযাত্রীরা। এরপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করবেন। কোরবানি করে মাথা মুণ্ডন করবেন। এহরাম খুলে পরবেন সাধারণ পোশাক। আবার কাবাঘর তাওয়াফ করবেন। সাফা-মারওয়ায় সাতবার চক্কর দেবেন। আবার ফিরে যাবেন মিনায়। আরব নিউজ লিখেছে, এবার ভয়াবহ গরমে পালিত হচ্ছে হজের আনুষ্ঠানিকতা। মাথার উপরে গণগণে সূর্য্য। তাপমাত্রা উঠে যাচ্ছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হজ শুরু হওয়ার পর হজযাত্রীদের মাথায় কোন ‘হ্যাট’ বা টুপি জাতীয় জিনিস পরার বিধান নেই। তাই অনেককে দেখা গেছে ছাতা ব্যবহার করেন মাথার উপর। কেউবা জায়নামাজ ব্যবহার করে সূর্য্যের তাপ থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময়ে নারীদের মাথায় অবশ্যই স্কার্ফ পরতে হয়। ইরাকের ৬৪ বছর বয়সী লায়লা বলেছেন, এই তাপমাত্রা আমরা সহ্য করতে পারি। আমরা তো হজ করতে এসেছি। যত বেশি কষ্ট সহ্য করবো, ততই বেশি হজ কবুল হবে। ভয়াবহ এই গরমের মধ্যে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ তাদের আয়োজন সম্পন্ন করে। হজযাত্রীদের মধ্যে একটি ট্রাকে করে বিতরণ করা হয় ছাতা, পানির বোতল ও ছোট ছোট ফ্যান।